১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে ২১ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার ‘র’ (RAW) গঠন করেছিল। ভারতে আইবি এবং সিবিআই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সমাধান করে। RAW দেশের বাইরের গোয়েন্দা বিষয়গুলি দেখাশোনা করে। গত ৫৮ বছরে এমন অনেক গুপ্তচর এসেছে যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। রবীন্দ্র কৌশিক, আর. এন. কাভ, সেহমত খান, অজিত ডোভাল মাত্র কয়েকটি নাম, যারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করেছেন। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এমন একজন গুপ্তচর ছিলেন, যাকে দেশের প্রথম গুপ্তচর বলা হয়। ভগৎরাম তলওয়ার ওরফে ‘সিলভার’ নামে পরিচিত এই গুপ্তচর শুধু ভারত নয় বিশ্বের আরও অনেক দেশের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন।
ভগৎরাম তলওয়ার ওরফে ‘সিলভার’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতসহ অনেক দেশের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন। ‘সিলভার’ এমন এক গুপ্তচর যার থেকে হিটলারও রেহাই পাননি।
ভগৎরাম তলওয়ার বাস্তব জীবনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। কথিত আছে যে ১৯৪১ সালে সুভাষ চন্দ্র বসুকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিতে ভগৎরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরপর এই দুই বিপ্লবী একসঙ্গে কলকাতা থেকে কাবুল ভ্রমণ করেন, নেতাজি জার্মানিতে যান। ভগতরাম তলওয়ার প্রায় ৫টি দেশের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু তিনি এতটাই কৌশলী ছিলেন যে সুভাষ চন্দ্র বসুও তাঁর গুপ্তচর হওয়ার কথা জানতেন না। ভগৎরাম সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর আসল রূপ চিনতে পারা শুধু কঠিনই ছিল না, অসম্ভব ছিল। তিনি ৬০টিরও বেশি নাম ধারণ করতেন। এর মধ্যে একটি ছিল ‘সিলভার’।
প্রকৃতপক্ষে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক গুপ্তচর ডাবল, ট্রিপল এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছিলেন। বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক মিহির বোস তাঁর ‘সিলভার: দ্য স্পাই হু ফুলড দ্য নাৎসি’ বইয়ে রহমত খান ওরফে ভগতরাম তলওয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯৪১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভগৎরামকে সুভাষ চন্দ্র বসুকে ভারত থেকে নিয়ে কাবুলে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিজের দায়িত্ব পালনে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। এদিকে, একজন ক্লিন শেভড ব্যক্তি কাবুলের ইতালীয় দূতাবাসে পৌঁছালেন এবং গেটে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডের কাছে নিজেকে একজন শেফ হিসাবে পরিচয় দিলেন। জানালেন রাষ্ট্রদূতের হয়ে কাজ করার জন্য তাঁকে বিশেষভাবে ডাকা হয়েছে। আফগান পোশাক পরিহিত অই ব্যক্তি দেখতে যেন একেবারে পাঠানের মতো ছিল। তাই প্রহরীরাও সন্দেহ করেনি এবং সহজেই দূতাবাস অভ্যন্তরে যেতেও দেওয়া হয়। ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করলে রাষ্ট্রদূত তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন কে তাঁকে পাঠিয়েছে? উত্তরে তিনি বলেন যে আফগানিস্তানে জার্মান কোম্পানি সিমেন্সের প্রধান হের থমাস পাঠিয়েছেন।
এই বিষয়ে রাষ্ট্রদূত জিজ্ঞেস করলেন কেন তাকে পাঠানো হল? ওই ব্যক্তি জানান তাঁর জানা নেই। শুধু রাষ্ট্রদূতকে দেখতে পাঠানো হয়েছে। এই উত্তর শুনে ইতালির রাষ্ট্রদূত বুঝতে পারলেন তিনি সাধারণ আফগান নন, বিশেষ কোনও ব্যক্তি। এরপর রাষ্ট্রদূত সেখানে বসা লোকজনকে চলে যেতে বলেন। এরপর সেই ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন যে তাঁর নাম রহমত খান। তিনি কোনও রাঁধুনি বা আফগান নন, বরং একজন ভারতীয় এবং তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুকে কাবুলে আনতে চান। আর এই ব্যাপারে ইতালির সহায়তা দরকার। রহমত খান আর কেউ নন ভগৎরাম তলওয়ার ওরফে ‘সিলভার’। রহমত খান এবং ইতালির রাষ্ট্রদূত পিটার কুরিনির সহায়তায় সুভাষ চন্দ্র বসু ভারত থেকে পালিয়ে কাবুলে যান। প্রায় একমাস কাবুলের রাস্তায় ঘোরাঘুরি করার পর রহমত খান ও সুভাষ চন্দ্র বসু আফগানিস্তান ছেড়ে আবার ইতালির ওই রাষ্ট্রদূতের সহায়তাতেই জার্মানিতে পৌঁছান।
সিলভার বোকা বানিয়েছিলেন হিটলারকেও। পিটার কুরিনির সঙ্গে দেখা করার পর ভগৎরাম তলওয়ার ‘সিলভার’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তচরদের মধ্যে গণ্য হতে শুরু করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে, সিলভার ১২ বার পায়ে হেঁটে কাবুল ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি ইতালি, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান এবং ব্রিটেনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন একজন কট্টর ভারতীয় এবং দেশের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র প্রতি অনুগত। কয়েক মাস ইতালিতে কাজ করার পর ভগৎরামকে জার্মানিতে পাঠানো হয়। নাৎসিরা তাঁকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর কাবুলে ফেরত পাঠায়। সেখানে সিলভারকে দেওয়া হয় ফ্ল্যাট, প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার। সেই অর্থ ভগৎরাম ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’কে সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। কমিউনিস্ট ‘সিলভার’-এর নাৎসি এবং ইতালিকে সাহায্য করার কোনও ইচ্ছা ছিল না। সেইজন্য তিনি হিটলার ও ইতালিকে ভুয়ো তথ্য দিতে শুরু করেন। তখন এই ধরনের তথ্য যাচাইয়ের কোনও উপায় ছিল না।
ভগৎরাম ওরফে সিলভার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিখোঁজ হয়ে যান। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারতও স্বাধীন হয়। দেশভাগের সময় সিলভারের ধারণা ছিল যে তিনি হিন্দু হয়ে পাকিস্তানে থাকতে পারবেন না। এই কারণেই তিনি গোয়েন্দাগিরি করে পাওয়া কোটি কোটি টাকা নিয়ে ভারতে চলে আসেন। অবশেষে, ৭৫ বছর বয়সে, ভগৎরাম তলওয়ার ওরফে ‘সিলভার’ ১৯৮৩ সালে মারা যান।