কেউ মুণ্ডহীন, কারও হাত-পা কাটা, কারও আবার ছিন্ন শরীর, সবুজ গভীর অরণ্যের প্রতিটি গাছে দোদুল্যমান এমনই বিকৃত চেহারার ছোট-বড় আকারের নানা পুতুল। জঙ্গলের আলো-ছায়ায় এই পুতুলগুলিকে দেখতে লাগে আরও কদাকার। যতদূর চোখ যাবে এমন হাড় হিম করা দৃশ্যই চোখে পড়বে। কী ভাবছেন এইসব কোন ভুতুড়ে সিনেমার প্লট? আজ্ঞে না। বাস্তবেই এমন একটি জায়গা রয়েছে মেক্সিকো সিটির দক্ষিণে। জায়গাটির নাম ‘দ্য আইল্যান্ড অফ ডলস’।
জলরাশির মাঝে সবুজে ঘেরা একটি দ্বীপ। দূর থেকে দেখলে চোখ ভরে আসে তার সবুজ বাহারে। অথচ এই দ্বীপে পা রাখলেই শিউরে উঠতে হয়। আলো-ছায়ার মাঝে এই দ্বীপের প্রতিটা গাছ থেকেই যেন ঝুলে রয়েছে একাধিক বিকৃত, কদাকার চেহারার পুতুল। নানা ভঙ্গিমায় তারা যেন কিছু ইঙ্গিত করছে।
তবে এই নির্জন দ্বীপে কে-ই বা পুতুল ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল? এমন বিকৃত করারই বা কারণ কী? এই কাহিনী উদ্ঘাটন করতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছু বছর আগে। জনমানবশূন্য এই দ্বীপে এক সময় পরিবার ত্যাগ করে বসবাস করতে শুরু করেন ডন জুলিয়ান সান্তানা বরেরা নামে এক ব্যক্তি। জুলিয়ান নামে এই ব্যক্তির জীবনের সঙ্গেই লুকিয়ে রয়েছে এই পুতুল দ্বীপের রহস্য।
বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্ত্রী ও পরিবার ত্যাগ করেছিলেন জুলিয়ান। শুধু পরিবারের থেকেই নিজেকে আলাদা করে নেননি, সমাজ থেকেও নিজেকে আলাদা করে নিয়ে থাকতে শুরু করেন এই নির্জন দ্বীপে। জানা যায়, এই দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যেই ঝোপ-জঙ্গলে ঢাকা একটি নালা থেকে এক বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করেন তিনি। জুলিয়ানের দাবি, পাশের একটি হ্রদে মেয়েটি ডুবে গিয়েছিল। তারপর তার মরদেহ ভেসে আসে এই নালায়। এর কিছু দিন পর নালার ঠিক ওই একই জায়গায় একটি পুতুলও ভেসে আসে।
এই ঘটনার পরই এক লহমায় বদলে যায় জুলিয়ানের জীবন। ভুতুড়ে উপদ্রব শুরু হয় নির্জন দ্বীপ জুড়ে। সারা দিনই বাচ্চা মেয়ের ফিসফিস শুনতে পেতে শুরু করেন জুলিয়ান। মেয়েটির খেলার শব্দ, ছুটে বেড়ানোর শব্দও প্রতিনিয়ত কানে আসতে শুরু করে তাঁর।ভীত জুলিয়ান বাচ্চা মেয়েটির আত্মাকে শান্তি দিতে ও এই উপদ্রব থেকে বাঁচতে একটা উপায় বার করে নিলেন। মেয়েটির সঙ্গে ভেসে আসা পুতুলটিকে নালা থেকে তুলে এনে পাশেই একটা গাছে ঝুলিয়ে দেন।
এভাবেই ওই নির্জন দ্বীপে নিজের জীবনের বাকি ৫০ টা বছর কাটান জুলিয়ান। বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন সব নানা পরিত্যক্ত পুতুল তুলে এনে দ্বীপের গাছগুলিতে ঝোলাতে শুরু করেন তিনি। একটি একটি করে দ্বীপের প্রায় সব গাছই ভরে যায় এমন বিকৃত চেহারার পরিত্যক্ত পুতুলে।
২০০১ সালে ডন জুলিয়ানের মৃত্যুও হয় রহস্যজনক ভাবে। যে নালায় বাচ্চা মেয়েটির মৃতদেহ দেখার দাবি করেছিলেন তিনি, ঠিক সেখানেই ডুবে মারা যান জুলিয়ান। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে এই পুতুল দ্বীপের রহস্যও চাপা পড়ে গিয়েছে।
মেক্সিকোর এই পুতুল দ্বীপ পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অসংখ্য পুতুল ছাড়াও এই দ্বীপে একটি জাদুঘর রয়েছে। সেখানে দ্বীপ সংক্রান্ত প্রকাশিত সমস্ত খবরের কাগজের ক্লিপিং যত্ন করে রাখা রয়েছে। জুলিয়ানের সেই প্রথম পুতুলটিও সংগ্রহ করে রাখা রয়েছে এখানে। অনেক পর্যটকই ওই বাচ্চা মেয়ে এবং জুলিয়ানকে সম্মান জানাতে সঙ্গে করে পুতুল নিয়ে এসে দ্বীপের গাছে ঝুলিয়ে দেন।
রহস্যময় এই পুতুল দ্বীপ আমেরিকান টেলিভিশন ট্রাভেল চ্যানেলে ‘ঘোস্ট অ্যাডভেঞ্চার’ নামে এক তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছিল। অ্যামাজন প্রাইম-এর সিরিজ ‘লোর’-এও এই দ্বীপের রহস্য দেখানো হয়েছে। তবে সত্যিই জুলিয়ান নালায় কোনও বাচ্চা মেয়ের মৃতদেহ দেখেছিলেন কি না বা সেই মেয়েটির আত্মা এই দ্বীপে ঘুরে বেড়াত কি না, সেইসব এখনও জুলিয়ানের মৃত্যুর মতোই সমাধানহীন রহস্য হিসাবে রয়ে গিয়েছে।