বর্ধমান স্টেশন থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এমনই এক ‘অজ পারা গাঁ’য়ে শারদীয়ার সাজে সেজে ওঠেন দেবী সিংহবাহিনী। এবারও তার অন্যথা হয়নি। আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছর আগে শুরু হয়েছিল এই পুজো।
গ্রামের সোম ও আরও দুটি পরিবার মিলে এই পুজোর আয়োজন হয়। সোম পরিবারের বর্তমান সদস্য বিশ্বজিৎ সোমের কাছ থেকে জানা গিয়েছে অতীতে দেবী সিংহবাহিনী ছিলেন কষ্টিপাথরের। সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশ কেউই থাকতেন না। পরবর্তীতে বর্গী হানায় সেই মূর্তি চুরি যায়। এরপর দেবীর স্বপ্নাদেশ মেনে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেন দুই পরিবার।যথারীতি মহাষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত ভক্তি সহকারে পুজোও হয়। দশমীতে নিয়ম মেনে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। এরপরই দেবী আবার স্বপ্নাদেশ দেন। তৎকালীন এক সেবায়েতকে স্বপ্ন দেখিয়ে দুর্গতিনাশিণী বলেন, ‘আমাকে কেন জলে দিলি? আমি দশমীতে নিরঞ্জিত হতে চান না। আগামী কোজাগরী পূর্ণিমার শেষ লগ্নে আমার পুজো করবি। প্রতিপদে আমি বেদী থেকে উঠব। জল থেকে উঠিয়ে আবার আমার পুজো কর।” দেবীর নির্দেশে প্রথমে রাজি হননি স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাই মাকে তিনি নির্দ্বিধায় জানান তাঁদের সাধ্য কোথায় মাকে এতদিন রাখার? মায়ের ভোগান্ন তৈরির যে বিপুল খরচ তা কোথায় পাবেন তাঁরা! এবারও মহামায়া তাঁর সন্তানকে আশ্বস্ত করে বলেন তাঁর ঘি, দধি, দুগ্ধ, ছানা কিছুই দরকার নেই। ভক্তিভরে যতটুকু সাধ্য তাই যেন আয়োজন করা হয়। আর একান্তই যদি কিছু না করতে পারেন তাহলে ভেজানো ছোলা ও থোঁড় কুঁচির নৈবেদ্য দিয়েই দেবীর আরাধনা হোক। মায়ের নির্দেশ মেনে নিয়ে দেবীকে জল থেকে তুলে পুনরায় পুজো শুরু করেছিলেন সেবায়েতরা। সেদিনের সেই প্রথা আজও চলছে। তাই দশমীতে ঘরের মেয়েকে বিদায় জানায় না কাদিগাছা গ্রাম, ষষ্ঠী থেকে পরের প্রতিপদ পর্যন্ত দেবীর আরাধনায় রত থাকেন। ফল ফলাদি যাই দেওয়া হোক না কেন ভেজানো ছোলা ও থোঁড় কুঁচির নৈবেদ্য মাকে দেওয়া আবশ্যক। পূর্ণিমা পুজো চলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। দেবী সিংহবাহিনী অত্যন্ত জাগ্রত বলে পরিচিত। বহু মানুষ দেবীর কাছে মানত করেন। সেই মানত পূরণ হয় বলেও জানা গিয়েছে। দেবীর কৃপায় চরম রোগগ্রস্ত মানুষও সুস্থ হয়ে ওঠেন বলে বিশ্বাস গ্রামবাসীর।
দেবী সিংহবাহিনীর পাশে থাকেন জয়া বিজয়া নামে দুই পরী। কষ্টিপাথরের মূর্তির সময় না থাকলেও পরে মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে জয়া-বিজয়া আসেন। কাদিগাছা গ্রামে এই একটিই দূর্গাপুজো হয়। তাই পারিবারিক হলেও পুজোয় গোটা গ্রাম সবরকমের সহযোগিতা করেন। যুব সম্প্রদায় মিলে যাত্রা, থিয়েটারের মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন। তিন বছর অন্তর অন্তর পরিবারত্রয়ের মধ্যে পালা বদল হয় পুজোর। সব মিলিয়ে আজও ব্যতিক্রমী ধারা বহন চলেছে কাদাগাছির সিংহবাহিনী দেবীর পূজা।