বহু বছর আগে শোনা যায়, একটি নেকলেসের জন্যই নাকি প্রাণ দিতে হয়েছিল ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের ডাকসাইটে সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বময়ী রানি মারি আঁতোয়ানেতকে। অমিতব্যয়িতা এবং বহুগামিতার জন্য খ্যাত এই সম্রাজ্ঞীর জন্যই নাকি ফ্রান্সের দেউলিয়া অবস্থা হয়েছিল। ষোড়শ লুইয়ের শিরচ্ছেদের পর তাঁকেও গিলোটিনে চ়়ড়ানো হয়।

যার জন্য প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল আঁতোয়ানেতকে, কেমন দেখতে ছিল ‘অভিশপ্ত’ সেই নেকলেস?

মাস দুয়েক আগে আবার জনসমক্ষে আনা হয় চোখধাঁধানো হিরে দিয়ে তৈরি সেই গলার আভূষণটিকে। বিখ্যাত নিলাম সংস্থা ‘সদবি’ আঁতোয়ানেতের সেই নেকলেসটিকে নিলামে চড়ায়।

১৩ সেপ্টেম্বর জেনেভায় একটি নিলামে চড়া দামে বিক্রি হয় সেই হিরের নেকলেসটি, যাকে রানির পতনের কারণ বলে মনে করা হয়।

১৭৮০ সালে এই নেকলেসকে জড়িয়ে একটি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসে যা ফ্রান্সের শেষ রানি মেরি আঁতোয়ানেতের খ্যাতিকে ধূলিসাৎ করে দেয়। রানির পরকীয়া ও বিলাসের বহর জনসমক্ষে আসতেই ক্ষোভ চরমে ওঠে এবং এর ফলে ফরাসি বিপ্লব ত্বরান্বিত হয় বলে মনে করেন ইতিহাসবিদদের একাংশ।

সদবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রথমে মনে করা হয়েছিল ১৫ কোটি থেকে ২৩ কোটির মধ্যে বিক্রি হবে ঐতিহাসিক নেকলেসটি। সেই অনুমান ভুল প্রমাণ করে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৩০ কোটি টাকায় বিক্রি হয় আঁতোয়ানেতের স্মৃতিবিজড়িত এই গলার অলঙ্কারটি।

সদবির ‘রয়্যাল অ্যান্ড নোবেল জুয়েলস’ আয়োজিত এই নিলামের পর সমস্ত কর ও অন্যান্য খরচ যুক্ত হয়ে নেকলেসটির জন্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা চোকাতে হয়েছে ক্রেতাকে। এমনটাই জানা গিয়েছে সংবাদমাধ্যম সূত্রে।

৫০০ ভারতীয় হিরে দিয়ে তৈরি এই অপূর্ব আভরণটির সঙ্গে যে প্রতারণার কাহিনিটি জড়িয়ে রয়েছে তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই তার হদিস পাওয়া যায়।

বলা হয়ে থাকে, আঁতোয়ানেতের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া কার্ডিনাল রোহান নামে এক রাজপুরুষ অনুগ্রহ ফিরে পাওয়ার জন্য নেকলেসটি উপহার দিতে চান। ভিয়েনা থেকে রাষ্ট্রদূত হিসাবে ফিরে আসার পর সম্রাজ্ঞীর প্রতি তিনি আসক্ত হয়ে পড়েন। কোনও কারণে রানির নেকনজর থেকে দূরে সরে যান রোহান।

রানিকে প্রীত করতে একটি উপহারের সন্ধান করছিলেন তিনি। সেই সুযোগও মিলে যায়। সেই সময়ে রাজপরিবারের গহনা প্রস্তুতকারক বোহমার এবং ব্যাসেঞ্জ প্রায় ৬৫০টি হিরে ও প্রায় ২৮০০ ক্যারেট ওজনের একটি নেকলেস বিক্রি করার জন্য চেষ্টা করছিলেন।

অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় সেই সময় রানি তা কিনতে রাজি হননি। সেই সময় লা মোতে নামে এক প্রভাবশালী রাজপরিবারের সদস্যার সঙ্গে যোগাযোগ হয় কার্ডিনালের। লা তাঁকে আশ্বস্ত করেন রানির সঙ্গে রোহানের পুনর্মিলন ঘটাতে দৌত্য করবেন তিনি।

অলঙ্কার নির্মাতাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল দুই বছরের মধ্যে চারটি কিস্তিতে সমস্ত অর্থ মিটিয়ে দিতে হবে। সেই মতো ১৭৮৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কার্ডিনালের কাছে নেকলেসটি হস্তান্তর করা হয়। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন লা মোতে।

রানিকে নেকলেসটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য কার্ডিনালের হাত থেকে তা নিয়ে পালিয়ে যান তিনি। পরে গহনার দাম না দেওয়ার জন্য রানির কাছে নালিশ করেন বোহমার। মন্ত্রিসভা থেকেই গ্রেফতার হন কার্ডিনাল। তার পরই সমস্ত ঘটনা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

ঘটনায় জড়িত লা মোতে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান ও সেখানে আঁতোয়ানেত সম্পর্কে কেচ্ছা ছড়িয়ে দেন। পরে রানিকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করা গেলেও সেই সময় এই ঘটনা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল ফ্রান্সের আমজনতার মধ্যে।

এই বিশ্বখ্যাত নেকলেসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের নামও। এই নেকলেসের গাঁথা সব ক’টি হিরে তোলা হয়েছিল গোলকুন্ডা খনি থেকে। ১৭২০ সালে ব্রাজিলে হিরের খনি আবিষ্কারের আগে অবধি রাজাদের হিরে মানেই ছিল ভারতের হিরে।

গোলকুন্ডার সেই উৎকৃষ্ট হিরে দিয়ে তৈরি এই নেকলেসটি বহু পরিবারের মধ্যে দিয়ে হাতবদল হয়ে শেষে বিংশ শতকে থিতু হয় ইংল্যান্ডের মার্কেস অফ অ্যাঙ্গেলসি পরিবারে। সদবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি সম্ভবত ফরাসি বিপ্লবের আগের দশকে তৈরি হয়েছিল।

মার্কেস অফ অ্যাঙ্গেলসি পরিবারের সদস্যেরা জনসমক্ষে মাত্র দু’বার নেকলেসটি পরেছিলেন বলে মনে করা হয়। এক বার ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেকের সময় এবং এক বার ১৯৫৩ সালে তার কন্যা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here