১২ বছর পর প্রয়াগরাজে শুরু হয়ে গিয়েছে মহাকুম্ভমেলা। এখানে ঘুরতে এলে শুধু কুম্ভ ঘুরেই চলে যাবেন তা কখনও হয়। উত্তরপ্রদেশের প্রাচীন শহর যা এককালে প্রয়াগতীর্থ বলে পরিচিত ছিল, যার উল্লেখ ঋগ্বেদেও রয়েছে, যা মৌর্য এবং গুপ্ত যুগের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এবং যেখানে পনেরো শতকে ‘ইল্লাহাবাস’ নামে শহরের পত্তন করেছিলেন সম্রাট আকবর, সেই শহরের নাম পরে বদলে যায়। ইল্লাহাবাস হয় ইলাহাবাদ এবং সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের শাসনকালে তার নাম আবার বদলে হয় প্রয়াগরাজ, যে শহরে ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের কাহিনির ছড়াছড়ি।
বেড়াতে যাওয়া যখন কালেভদ্রে হয়, তখন ছুটি নিয়ে প্রয়াগরাজের মতো শহরে গিয়ে শুধু তীর্থভ্রমণ করে ফিরে আসবেন কেন! বরং কুম্ভদর্শনের পর হাতে দু’-তিন দিন বাড়তি সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন শহরের কিছু ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এলাকাও। তাতে তীর্থ যেমন হবে, তেমনই ভ্রমণও হবে।
ইলাহাবাদের কেল্লা
আবুল ফজ়ল তাঁর ‘আকবরনামা’য় লিখেছেন, তীর্থক্ষেত্র প্রয়াগে একটি শহরের পত্তন করার ইচ্ছে বহু বছর ধরেই পালন করছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। সেই দুর্গ তিনি তৈরিও করেন। সেই দুর্গই আকবর ফোর্ট বা ইলাহাবাদ কেল্লা নামে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের প্রয়াগরাজে। দুর্গটি ১৫৮৩ সালে তৈরি করেছিলেন আকবর। তাঁর বানানো সবচেয়ে বড় দুর্গ ওটিই। ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন আশার লিখছেন, সেকালে সম্রাটের বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে বিদ্রোহের আঁচ তৈরি হচ্ছিল। তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসাবেও ওই দুর্গ তৈরি করেন আকবর। তবে ওই দুর্গ ঘিরে নানা রকমের লোকগাথা রয়েছে। তার মধ্যে একটি এমনও বলে, যে আকবর পূর্বজন্মে প্রয়াগেরই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন। এবং আত্মঘাতী হয়ে মুসলমান হন এবং ফিরে এসে প্রয়াগে ওই দুর্গ তৈরি করেন। আরও একটি কাহিনিতে বলা হয়, আকবরের ওই দুর্গের ভিত কিছুতেই দাঁড়াচ্ছিল না। ব্রাহ্মণেরা সম্রাটকে বলেন, নরবলি দিলে তবেই ওই ভিত দাঁড়াবে। শুনে এক ব্রাহ্মণ স্বেচ্ছায় নিজেকে বলি দেন। তার পরেই নাকি তৈরি করা হয় দুর্গ। আকবর ওই ব্রাহ্মণের পরিবারকে প্রয়াগওয়াল বলে ঘোষণা করেন। অর্থাৎ তাঁরা, যাঁরা প্রয়াগের তীর্থে আসা পুণ্যার্থীদের বিশেষ সেবা করার অধিকার পাবেন।
অক্ষয় বট
আকবরের দুর্গের মধ্যেই রয়েছে অক্ষয় বট। নামেই পরিচয়। যে বটবৃক্ষের ক্ষয় নেই। হিন্দু পুরাণে বলা আছে, ওই বটবৃক্ষে পূর্ণ বিশ্বাসে পুজো করলে যিনি পুজো করছেন, তিনি সর্বপাপমুক্ত হন। পদ্মপুরাণে, এমনকি জৈন লিপিতেও অক্ষয় বটের উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতেও রয়েছে অক্ষয় বটের উল্লেখ। প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী আকবর ওই অক্ষয় বটকে রক্ষা করলেও তাঁর পুত্র জাহাঙ্গির গাছটিকে গোড়া থেকে কেটে ফেলেন। কাটা অংশের উপর একটি গরম লোহার আঁকশি গেঁথে দেন, যাতে ভবিষ্যতে ওই গাছ আর বাড়তে না পারে। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই গাছটি পল্লবিত হতে শুরু করে।
খুসরো বাগ
প্রয়াগরাজ স্টেশনের কাছেই আকবরের দুর্গ থেকে ৬ কিলেমিটারের দূরত্বে খুসরো বাগ। ৪০ একর এলাকা জুড়ে তৈরি ওই বাগ বা বাগানে রয়েছে চারটি স্মৃতি সৌধ। একটি জাহাঙ্গিরের স্ত্রী শাহ বেগমের, যিনি আমেরের রাজকন্যা ছিলেন। দ্বিতীয় স্মৃতিসৌধটি জাহাঙ্গির এবং শাহ বেগমের জ্যেষ্ঠ সন্তান খুসরো মির্জার। যিনি কিছু দিনের জন্য মোগল সম্রাজ্যের অধিপতি হন। তৃতীয় সৌধটি খুসরোর সহোদরা তথা জাহাঙ্গিরের কন্যা নিঠার বেগমের। চতুর্থ সৌধটি বিবি তামোলানের। প্রতিটি সৌধই মোগল স্থাপত্যে তৈরি। দেওয়ালে মিনাকারি কাজ। প্রয়াগে এসে খুসরো বাগ না দেখলে অনেক কিছুই না দেখা থেকে যাবে।
আনন্দ ভবন
নেহরু পরিবারের বাড়ি। কিনেছিলেন মতিলাল নেহরু। তার আগে ইলাহাবাদেরই স্বরাজ ভবনে ছিল নেহরুর বাসভবন। পরে সেটি কংগ্রেসের স্থানীয় সদর দফতর হওয়ায় আনন্দ ভবনে চলে আসেন নেহরুরা। পরে বাড়িটি সরকারকে দান করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বর্তমানে আনন্দ ভবন একটি মিউজ়িয়াম হিসাবে সংরক্ষিত। আনন্দ ভবনে রয়েছে জওহর প্ল্যানেটরিয়ামও।
স্বরাজ ভবন
১৮৭১ সালে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন সৈয়দ আহমেদ খান। বাড়িটির নাম ছিল মেহমুদ মঞ্জিল। পরে সেটি নেহরু পরিবারের বাসভবন হয়। তখন নাম হয় আনন্দভবন। তারও পরে যখন ওই বাড়িটিকে স্থানীয় কংগ্রেস সদর দফতর করা হয় তখন নাম পাল্টে হয় স্বরাজ ভবন। এই বাড়িটিতেও রয়েছে মিউজ়িয়াম।
পত্থর গির্জা
প্রয়াগরাজের অল সেন্টস ক্যাথিড্রালের আর এক নাম পত্থর গির্জা। পাথরের তৈরি গথিক স্থাপত্যের ওই গির্জা তৈরি করেছিলেন ব্রিটিশ স্থপতি উইলিয়াম এমার্সন, যিনি কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি করেছিলেন।
ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়
ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যও দেখার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবন ভিজিয়ানাগরাম হলের মাথার গম্বুজটি নীল পাথরে মোড়া। ব্রিটিশ এবং ইসলাম স্থাপত্যের মিশ্রণে তৈরি ওই ভবনটিও তৈরি করছিলেন ব্রিটিশ স্থপতি এমার্সনই।
ইলাহাবাদ সাধারণ গ্রন্থাগার
স্কটল্যান্ডের ব্যারন সংস্কৃতির যে স্থাপত্য, তাতেই অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি প্রয়াগরাজের সাধারণ গ্রন্থাগার, যার আর এক নাম থর্নহিল মেইন মেমোরিয়াল। ১৮৬৪ সালে তৈরি ওই গ্রন্থাগারটি গোটা উত্তরপ্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। গ্রানাইট আর বালি পাথরের পিলার এবং ঢালু ছাদের ছুঁচলো মাথার স্থাপত্য দেখার মতো।
কোম্পানি পার্ক বা চন্দ্রশেখর আজ়াদ পার্ক
গ্রন্থাগার সংলগ্ন পার্কটির নাম আগে ছিল আলফ্রেড পার্ক, যাকে কোম্পানি পার্ক বলেও চিনতেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে তার নাম বদলে রাখা হয় বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজ়াদের নামে। ১৩৩ একর এলাকা জুড়ে পার্কের ভিতরে রয়েছে আজ়াদের স্মৃতিসৌধ, প্রয়াগ সঙ্গীত সমিতি, মদন মোহন মালব্য স্টেডিয়াম, ইলাহাবাদ মিউজ়িয়ামও।
ইলাহাবাদ স্তম্ভ
আকবর দুর্গের ভিতরেই রয়েছে ইলাহাবাদ স্তম্ভ। ৩৫ ফুট উঁচু ওই স্তম্ভের গায়ে রয়েছে ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের লিপি। মৌর্য সম্রাট অশোক থেকে শুরু করে গুপ্ত যুগের রাজা সমুদ্রগুপ্ত, মোগল সম্রাট আকবর, বীরবলের মাঘমেলার লিপি, এমনকি জাহাঙ্গিরের লিপিও খোদাই করা হয়েছে ওই স্তম্ভের গায়ে। ওই স্তম্ভ এবং দুর্গ চত্বর এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে। স্তম্ভ দেখার জন্য অনুমতিপত্রের প্রয়োজন হয়।