সম্রাট ঔরঙ্গজেব একবার বাংলায় যাচ্ছিলেন। তাদের সঙ্গে অনেক হিন্দু রাজাও ছিলেন। পালকি বেনারসে পৌঁছলে, রাজারা সেখানে থামতে অনুরোধ করেন যাতে রানিরা গঙ্গা স্নানের পরে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে পূজা করতে পারেন। রানিরা গঙ্গায় স্নান করতে গেলেন, পুজো করে ফিরেও গেলেন। কিছুক্ষণ পর জানা গেল কচ্ছের রানি ফিরে আসেননি। অনুসন্ধান করে দেখা গেল মন্দিরে একটি কুঠি রয়েছে। সৈন্যরা যখন দেওয়াল ভেঙে নিচে নেমে এলো, তখন তারা কি দেখলো যে সেখানে রানি কাঁদছেন। শরীরে কোনও গয়না ঞেই। এই দৃশ্য দেখে সব রাজাই খুব রেগে গেলেন। ঔরঙ্গজেব বললেন, যেখানে এত জঘন্য অপরাধ হয়েছে, সেখানে এখন কীভাবে ভগবানের পূজা করা যায়। তিনি মহন্তকে গ্রেফতার, মন্দির ভেঙে ফেলা এবং ভগবান বিশ্বনাথের দেবতা স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। রানি তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং কাছাকাছি একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন। তাই এভাবে জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মিত হয়। এই উপাখ্যানটি মধ্যপ্রদেশের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং রাজ্যপাল পট্টাভী সীতারামাইয়া তাঁর ‘ফেদারস অ্যান্ড স্টোনস’ বইতে লিখেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই গল্পের নেপথ্যে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে? প্রমাণ দেননি সীতারামাইয়া। তিনি লখনউ থেকে কারও শ্রবণের কথা লিখেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, মুঘল রাজবংশের ষষ্ঠ সম্রাটের জীবন এতটাই অশান্তিতে ভরপুর ছিল যে তার মধ্যে এমন সব গল্পকথা বেরিয়ে আসতেই পারে। কিন্তু ইতিহাস বলে যে ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে অনেক মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছিল। আবার বহু মন্দির দানও করা হয়েছিল।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙ্গে জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণের কথা বলা যায় এটি ১৬৬৯ সালের ঘটনা। প্রায় একই সময়ে বেনারসে কিছু জমিদারের মধ্যে বিদ্রোহ হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছত্রপতি শিবাজিকে সাহায্য করেছিলেন বলে মনে করা হয়। আওরঙ্গজেব ছত্রপতিকে আগ্রা দুর্গে বন্দী করেছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে রাজা জয় সিং, যিনি রাজা মান সিং এর বংশধর ছিলেন, সেখান থেকে শিবাজীকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন। মান সিং ছিলেন সেই রাজা যিনি আকবরের হয়ে হলদিঘাটিতে মহারানা প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। কথিত আছে মান সিং কাশী বিশ্বনাথ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে জমিদারদের বিদ্রোহ এবং রাজা জয় সিং-এর কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট ১৬৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে মন্দিরটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন।

সেই ঔরঙ্গজেবই ১৬৫৮ সালে সম্রাট হওয়ার পর বেনারসের মন্দির ভাঙচুর না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যদিও ঔরঙ্গজেব ও বেনারসের সম্পর্ক নিয়ে একক মতামত নেই। কিছু লোক বিশ্বাস করে যে মন্দির ভাঙার সাঙে কোনও বিদ্রোহের সম্পর্ক ছিল না।

শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র দারাশিকোর সঙে যুদ্ধের সময় জয় সিং ঔরঙ্গজেবকে সমর্থন করলেও আলমগীর কিন্তু জয় সিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে পরে সতর্ক হন।  এরপর আসে ছত্রপতি শিবাজীর ঘটনা। ছত্রপতি ১৬৬৬ সালে আগ্রা দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন। জয় সিং-এর ছেলে রাম সিং এই বিষয়ে সরাসরি সাহায্য করেন। তাই ঔরঙ্গজেবের নজর ছিল রাম সিংয়ের দিকে।

১৬৬৭ সালে জয় সিং-এর মৃত্যুর পর রাম সিং যখন অম্বরের রাজা হন, ঔরঙ্গজেবও সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। রাম সিংকে কিন্তু ক্ষমা করে দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট, তিনি অম্বররাজকে রাজা উপাধি দেন। কিন্তু এই ঘটনার মাত্র দুই বছর পরে, সম্রাট রাম সিংয়ের পূর্বপুরুষদের অন্তর্গত বেনারস মন্দিরটি ভেঙে দেন। কেউ কেউ বলছেন এর পেছনে আসলে হিন্দুদের প্রতি ঔরঙ্গজেবের বিদ্বেষ ছিল।

ইতিহাসবিদ কে এন পানিক্কর আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন। দারাশিকোর প্রতি অবিচারের কারণে অনেক সুফি সাধক ঔরঙ্গজেবের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। দারা কিছুদিন বেনারসে ছিলেন। সেই সুফি বিদ্রোহী এবং মন্দিরের পণ্ডিতরা বেনারসে হাত মিলিয়েছিল। ঔরঙ্গজেব ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে মন্দিরটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন।

যাইহোক, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির এবং ঔরঙ্গজেবের সম্পর্কের বিষয়ে যাই বলা হোক না কেন, সিংহাসনের জন্য দারাশিকোর সঙে ঝগড়ার সময় ঔরঙ্গজেব যে ধর্মান্ধ মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এটা অন্য কথা যে রাজা জয় সিং এবং রাজা যশবন্ত সিং এর মতো অনেক হিন্দু রাজা তখন দারার পরিবর্তে ঔরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন।

দারাকে হত্যা করে বিবেকের দংশনে ভুগছিলেন সম্রাট। তাই  নিজেকে ধার্মিক দেখানোর জন্য, টুপি সেলাই করে পরার বাঃ তাঁর অর্থ দিয়ে ব্যক্তিগত খরচ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, গান-বাজনাও হয়ে উঠেছিল ঔরঙ্গজেবের কাছে বিরক্তের বিষয়। শুধু দশেরা-দিওয়ালিই নয়, ঈদের মতো উৎসবেও তিনি আড়ম্বর প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

ঔরঙ্গজেব ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব রায় মন্দিরও ভেঙে ফেলেন। মসির-ই-আলমগিরি নামে এক তথ্যমূলক বই বলে, সেখান থেকে মূর্তিগুলো আগ্রায় এনে বেগম সাহেব মসজিদের সিঁড়ির নিচে সমাহিত করা হয়।

উত্তর থেকে দক্ষিণে ঔরঙ্গজেবের শাসনামলে শত শত মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। পন্ধরপুরের বিঠোবার মন্দিরে হামলা থেকে শুরু করে বসন্তগড়ে মন্দির ভেঙে নিজের হাতে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন পর্যন্ত বহু ঘটনা রয়েছে তাঁর নামে। মসির-ই-আলমগিরি বলছে যে সম্রাট যখন চিতোরে যান, তাঁর আদেশে সেখানে ৬৩টি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here