মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অধুনা টলিউডের বড় অংশের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ রচনা করছেন। অন্তত দু’টি দৃষ্টান্ত তেমনই ‘ইঙ্গিত’ করছে। শুক্রবার আলিপুরের ‘সৌজন্য’ গৃহে আসন্ন বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠকে আমন্ত্রিতদের তালিকা এবং কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নেতাজি ইন্ডোর থেকে ‘ধনধান্য’ প্রেক্ষাগৃহে স্থানান্তরণের সিদ্ধান্ত।
হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন? বলা হচ্ছে খুব ছোট করে অনুষ্ঠান করা হচ্ছে, তাই সকলে আমন্ত্রিত নন। কিন্তু শাসক শিবির এবং প্রশাসনিক মহল জানে, কারণ আরজি কর আন্দোলন। আরজি কর-কাণ্ডের পরে ‘নাগরিক আন্দোলনে’ শামিল হয়েছিলেন টলিউডের অনেকে। কেউ কেউ সরাসরি নাগরিক মিছিলে না হেঁটে পৃথক ভাবেও মিছিল করেছিলেন। ‘বিচার’ চেয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন। এমনকি, শাসকদল তথা সরকার এবং কলকাতা পুলিশের ভূমিকার কড়া সমালোচনাও করতে পিছপা হননি। তারকাদের অনেকে টালিগঞ্জের স্টুডিওর সামনে জমায়েত হয়ে আরজি কর হাসপাতালের সামনে যাওয়ার কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে, তখন শ্যামবাজার থেকে আরজি কর পর্যন্ত জমায়েত বা মিছিল ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। মিছিলে যেমন ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, অঙ্কুশ হাজরা, আবির চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়েরা, তেমনই ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তথা পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ও। বেশিরভাগই পরেছিলেন কালো পোশাক।
আবার স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সোহিনী সরকার, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, বিদীপ্তা চক্রবর্তীদের মতো অভিনেত্রীরা নাগরিক মিছিলে পা মেলানোর পাশাপাশি ধর্মতলায় রাতভর অবস্থান করেছিলেন। সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তনীদের ডাকা মিছিলে দক্ষিণ কলকাতায় পা মিলিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পাওলি দাম, অরিন্দম শীল, টোটা রায়চৌধুরীরা।
তার মধ্যে আবার টালিগঞ্জের বিধায়ক অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাসকে এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন চলচ্চিত্র ফেডারেশনকে নিয়ে ‘সরব’ হয়েছিলেন পরিচালকেরা। আরজি করের ঘটনার পরে স্বরূপ তথা ফেডারেশনের ‘দাদাগিরি’র বিষয়টি নিয়ে সরব হতে থাকেন অনেকে। ফলে আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে আন্দোলনের সময় থেকেই নবান্নের সঙ্গে টালিগঞ্জের একটি অংশের দূরত্ব বাড়তে থাকে।
যদিও সরকারের থেকে ‘সুযোগ-সুবিধা’ না-নেওয়ার উদাহরণও কম নয়। টালিগঞ্জের অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ নন। বা সরকারি অনুষ্ঠানে কোনও ভূমিকা পালন করেন না। ঘটনাচক্রে, আরজি করের আন্দোলন চলাকালীন কয়েক জন শিল্পী রাজ্যে সরকারি পুরস্কার এবং খেতাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা ‘পরিচিত’ তৃণমূল তথা বর্তমান সরকারের বিরোধী।
এই আবহেই শুক্রবার ‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন’-এর প্রস্তুতি বৈঠক উপলক্ষে আলিপুরের ‘সৌজন্য’ গৃহে একটি বৈঠক ডেকেছে রাজ্য সরকার। সেখানে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সেখানে আমন্ত্রিতদের তালিকায় টালিগঞ্জের শিল্পীদের সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জনপ্রতিনিধি করার রেওয়াজ শুরু করেছিলেন মমতা। ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বীরভূমে মমতা প্রার্থী করেছিলেন অভিনেত্রী শতাব্দী রায়কে। তার পরে চিরঞ্জিত চক্রবর্তী, সোহম চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, রাজদের বিধানসভায় পাঠানো থেকে মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, নুসরত জাহান, মিমি চক্রবর্তীদের লোকসভায় পাঠিয়েছিলেন মমতা। তারপর একে একে এসেছে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, জুন মালিয়াদের নাম। তাঁরা জিতে সাংসদও হয়েছেন। রাজনীতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেও খানিকটা মমতার কথা রাজি হয়েই ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে আবার ঘাটালে দাঁড়াতে রাজি হয়েছিলেন দেব।
তবে এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁর প্রকৃত বন্ধুকেই খুঁজছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।