শ্রীকৃষ্ণ বলে গিয়েছেন যে ভক্ত তাঁর উপর নিজের অধিকার মেনে নেন, তিনিও সেই ভক্তকে আপন করে নেন। কৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী হল গীতা। শ্রীমদ্ভগবত গীতায় বর্ণিত ভক্তি যোগের মাধ্যমে অর্জুনকে নিজের প্রিয় ভক্তদের সম্পর্কে জানান বাসুদেব। মনুষ্য কল্যাণের জন্য ৪টি সাধন ও নিজের প্রিয় ৫ ধরণের ভক্তদের লক্ষণ বর্ণনা করে অর্জুনকে কৃষ্ণের মধ্যে লীন হওয়ার জ্ঞান দেন বাসুদেব।
কৃষ্ণ বলেন, আমার মধ্যে মনোনিবেশ করে ‘আমি ভগবানেরই ও ভগবানই আমার- এ ধরণের নিত্য-নিরন্তর আমার মধ্যে নিমজ্জিত যে ভক্ত পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার (সগুণ-সাকার) উপাসনা করে, তাঁকে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী (উপাসক) মনে করি।’ প্রাণীমাত্রের ভালো করার জন্য রত ও সমস্ত স্থানে সমবুদ্ধি রাখে, এমন নির্গুণোপাসক নিজের ইন্দ্রিয়কে নিজের অধীনে করে চিন্তিত হতে পারে না, সব স্থানে পরিপূর্ণ, যা দেখা যায় না, নির্বিকার, অচল, ধ্রুব, অক্ষর ও অব্যক্তের উপাসনা করেন— তিনি আমাকেই লাভ করেন। কারণ নির্গুণ-নিরাকার রূপও আমারই, আমার সমগ্র রূপ থেকে পৃথক নয়। কিন্তু বৈরাগ্যের অভাব ও দেহাভিমানের কারণে যাঁর চিত্ত নির্গুণ তত্বে তল্লীন হয়নি, নির্গুণ উপাসনার ক্ষেত্রে এমন সাধকের অধিক কষ্ট হয়। কারণ দেহাভিমানের জন্য নির্গুণোপাসকরা নিজের সাধনায় কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। কিন্তু হে পার্থ! যে সম্পূর্ণ কর্ম আমাকে অর্পণ করে ও আমার পরায়ণ হয়ে অনন্য মনোভবে আমারই ধ্যান করে আমার উপাসনা করে, সেই আমার মধ্যে তল্লীন চিত্তসম্পন্ন ভক্তদের আমি স্বয়ং মৃত্যুরূপ সংসার সমুদ্র থেকে শীঘ্রই উদ্ধার করে দিই। তাই তুমি নিজের মন বুদ্ধিকে আমার মধ্যে নিমজ্জিত কর, তার পর তুমি আমার মধ্যেই বাস করবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
হে ধনঞ্জয়, যদি মন-বুদ্ধি আমাকে অর্পণ করতে নিজেকে অসমর্থ মনে কর, তা হলে তুমি অভ্যাস যোগের দ্বারা আমাকে লাভ করার ইচ্ছা কর। যদি তুমি অভ্যাস যোগেও নিজেকে অসমর্থ মনে কর, তা হলে শুধুমাত্র আমাকে লাভের উদ্দেশ্য রেখেই সমস্ত কর্ম কর। শুধু আমাকে লাভের উদ্দেশে কর্ম করলেও তুমি আমাকে লাভ করবে। যদি তুমি আমার জন্য কর্ম করতেও নিজেকে অক্ষম মনে কর, তা হলে তুমি সম্পূর্ণ কর্মের ফলের ইচ্ছা ত্যাগ করে দাও। অভ্যাস থেকে শাস্ত্রজ্ঞান শ্রেষ্ঠ ও ধ্যানের চেয়ে সর্ব কর্মের ফলের ইচ্ছার ত্যাগ শ্রেষ্ঠ। কারণ ত্যাগের কারণে তৎকাল পরমশান্তি লাভ করা যায়।
এখানে মনুষ্য কল্যাণের জন্য ৪টি সাধনের উল্লেখ করেন কৃষ্ণ। এগুলি হল, সমর্পণ যোগ, অভ্যাসযোগ, ভগবদর্থকর্ম ও কর্মফল ত্যাগ। সাধক নিজের রুচি, বিশ্বাস ও যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোনও একটি সাধন করে নিজের কল্যাণ করতে পারে। এবার কৃষ্ণ এই চারটি সাধনের দ্বারা সিদ্ধ ভক্তদের লক্ষণ বর্ণনা করেন।
১. সম্পূর্ণ প্রাণীদের মধ্যে আমাকে দেখতে পারে আমার এমন ভক্তের কোনও প্রাণীর প্রতি দ্বেষ মনোভব থাকে না। শুধু তাই নয়, তাঁর সকল প্রাণীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও দয়ালুতার মনোভব থাকে। সে মমতা ও অহংকার মুক্ত, সুখ-দুঃখ লাভের প্রাপ্তিতে সম ও ক্ষমাশীল হয়। সে যে কোনও পরিস্থিতিতে নিরন্তর সন্তুষ্ট থাকে। সে নিত্য-নিরন্তর আমার সম্পর্ক অনুভব করে। শরীর-ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি স্বাভাবিক ভাবেই তার বশবর্তী হয়ে পড়ে। আমার মধ্যেই তার দৃঢ় নিশ্চয় হয়। তার মন ও বুদ্ধি আমার মধ্যেই অর্পিত থাকে। এমন ভক্ত আমার প্রিয়।
২. আমার ভক্তের জন্য কোনও প্রাণীর উদ্বেগ হয় না, এমনকি স্বয়ং সে-ও কোনও প্রাণীর কারণে উদ্বিগ্ন হয় না। সে হর্ষ, ঈর্ষা, ভয়, উদ্বেগ ইত্যাদি বিকার থেকে সর্বদা মুক্ত থাকে। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে আমি ছাড়া অন্য কারও কোনও সত্তা নেই। তা হলে সে কার প্রতি ঈর্ষা, উদ্বেগ, ভয় ইত্যাদি ব্যক্ত করবে এবং কেন করবে? এমন ভক্ত আমার প্রিয়।
৩. যে নিজের জন্য কোনও বস্তু, ব্যক্তি ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা রাখে না, যে শরীর ও অন্তঃকরণ থেকে পবিত্র, যা করার যোগ্য সেই কাজ (ভগবৎপ্রাপ্তি) করে নিয়েছে, যে ব্যক্তি যে কোনও পরিস্থিতিতে উদাসীন অর্থাৎ নির্লিপ্ত থাকে, যার হৃদয়ে দুঃখ-চিন্তা-শোকরূপ চাঞ্চল্য থাকে না এবং যে ভোগ ও সংগ্রহের উদ্দেশে কখনও কোনও কাজ শুরু করে না, সেই ভক্ত আমার প্রিয়।
৪. যে রাগ, দ্বেষ, হর্ষ ও শোক- এই চারটি বিকার মুক্ত, যে শুভ কর্মে রাগ করে না ও অশুভ কর্মে দ্বেষই করে, এমন ভক্ত আমার প্রিয়।
৫. যে শত্রু ও মিত্রের মধ্যে, মান ও অপমানে, শরীরের অনুকূলতা ও প্রতিকূলতায় এবং সুখ ও দুঃখে সমান মনোভব রাখে, প্রাণী-পদার্থে যাঁর কিঞ্চিৎমাত্র আসক্তি নেই, যে নিন্দা স্তুতিকে এক সমান মনে করে, যে নিরন্তর আমার স্বরূপের মনন করে, যে ব্যক্তি যে কোনও ভাবে শরীরের নির্বাহ হওয়া বা না-হওয়ায় সন্তুষ্ট থাকে, যাঁর থাকার স্থানে ও শরীরে নির্বাহ হওয়া ও না-হওয়ায় সন্তুষ্ট থাকে, যাঁর থাকার স্থানে ও শরীরে আসক্তি নেই ও যাঁর বুদ্ধি আমার মধ্যে স্থির, এমন ভক্ত আমার প্রিয়।