কলকাতা, বনেদিয়ানা, ঐতিহ্য প্রত্যেকটি শব্দ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। তিলোত্তমার বুকে আজও সাবেকিয়ানা বজায় রেখে শারদীয়ার আনন্দে মেতে ওঠেন বনেদি পরিবারগুলি। এই সব পরিবারে দূর্গাপুজো শুরু হওয়ার নেপথ্যে ছড়িয়ে থাকে হাজারো কাহিনি যা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। আজ জেনে নেওয়া যাক কল্লোলিনী কলকাতার বনেদি বাড়িগুলির শারদোৎসবের রোমহর্ষক গল্পগাঁথা।

জোড়াসাঁকোর দাঁ পরিবার- জন্মাষ্টমীর দিন বসানো হয় দুর্গার মস্তক

১৮৪০ সালে শিবকৃষ্ণ দাঁ প্রথম পরিবারের মধ্যে দূর্গাপুজোর প্রচলন করেন। শোনা যায়, সেই সময় দেবী সজ্জিত হয়েছিলেন ফরাসী গহনায়। সেই অলংকার দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন গোটা কলকাতাবাসী। রথের দিন হয় দাঁ পরিবারের প্রতিমার কাঠামো পুজো। প্রথা মেনে আজও গরাণ কাঠের কাঠামো তৈরি করেন পরিবারের সদস্যরা। জন্মাষ্টমীর দিন বসানো হয় দুর্গার মস্তক। প্রাণপ্রতিষ্ঠায় দেওয়া হয় ১৩টি শাড়ি ও ১৩টি কাঁসার বাসন। একথা বহুশ্রুত, ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দাঁ পরিবারের ছিল বেজায় রেষারেষি। ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্ম, মূর্তিপুজোয় অবিশ্বাসী। তাই দাঁ পরিবারের কর্তাদের হুকুম ছিল প্রতিমা ঠাকুর বাড়ির সামনে এনে ঢাক ঢোল বাজিয়ে তবে নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে।

ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ি- দুই নৌকার মাঝে দোলনায় চেপে আসতেন উমা

ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ির দূর্গোৎসব নিয়ে গল্পের শেষ নেই। এখানে রথের দিন কাঠামো পুজো হয়। প্রতিপদ থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত শালগ্রাম শিলা পুজো করে তৃতীয়াতে দেবীকে বসানো হয় আসনে। শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব এই তিন মতেই পুজো করা হয় এখানে। ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বড়িতে মা দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী সরস্বতী আসেন না, আসেন পদ্মাসনা জয়া বিজয়া। আগে বলি প্রথা ছিল। এখন পশুবলি বন্ধ। তার পেছনেও একটি কারণ রয়েছে। জানা যায়, বলির জন্য একটি ছাগলকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। আচমকা ছাগলটি দড়ি ছিঁড়ে বাড়ির কর্তার সামনে চলে যায়। অবলা প্রাণীটির চোখের দিকে চেয়ে বড় মায়ায় জড়ান গৃহকর্তা। তখন থেকে বন্ধ হয় রক্তবলি। আগে জোড়া নৌকায় প্রতিমা নিরঞ্জন হত। দুই নৌকার মাঝে দোলনায় চেপে আসতেন উমা। তারপর হত নিরঞ্জন।

বাগবাজারের হালদার বাড়ি-এখানে উমা দক্ষিণমুখী

বাগবাজারের হালদার বাড়িতে দেবী পূজিতা কষ্টিপাথরে। শোনা যায়, হালদার পরিবারের কোনও এক পূর্বপুরুষ বালেশ্বর গিয়েছিলেন। সেখানেই স্বপ্নাদেশে দেবী তাঁকে জানান কোনও এক মুসলমান জেলের বাড়ির ১৪ ফুট গভীরে রয়েছেন দেবী। সেই মতো মাটি খুঁড়লে পাওয়া যায় দেবী মূর্তি। এই পরিবারে উমা দক্ষিণমুখী। দূর্গাষষ্ঠী পালনের রীতি নেই। তার পরিবর্তে মাছ খেয়ে পান মুখে দিয়ে ঢাক বরণ করা হয়। বোধন হয় রেড়ির তেলের জাগপ্রদীপের মধ্য দিয়ে। প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে পর্যন্ত সেই প্রদীপ জ্বলা আবশ্যক।

সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ি-সিংহের মুখাবয়ব ঘোড়ার মতো

সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো হয় তন্ত্রমতে। তাই দেবীর সঙ্গে থাকেন দশমহাবিদ্যা। বিদ্যাপতির ‘দূর্গাভক্তি তরঙ্গিণী’তে লিখিত প্রথা মেনে এখানে পুজো হয়। ১৬১০ সালে প্রথম বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু হয়েছিল। দেবীর বাহন সিংহের মুখাবয়ব ঘোড়ার মতো। এই বাড়িতে রয়েছে আমিষ ভোগের প্রচলন। অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ১৮০ টা মাটির সরায় মাসকলাই ও দই দেওয়া হয় অপদেবতা ও উপদেবতাদের উদ্দেশ্যে।

হাটখোলার দত্তবাড়ি- অষ্টমীতে সিঁদুরখেলা

হাটখোলার দত্তবাড়ির সাবেক রেওয়াজ অনুযায়ী দূর্গা প্রতিমা মঠচৌড়ি পদ্ধতিতে পূজিতা। এই বাড়ির দূর্গা ঠাকুর শাড়ি পরেন না। পরিবর্তে তাঁর গায়ে তুলি দিয়েই ফুটিয়ে তোলা হয় বস্ত্রের মতো অপরূপ কারুকার্য। এই পরিবারে সিঁদুরখেলার নিয়ম অষ্টমীতে। তাই দশমীতে সিঁদুরখেলা হয় না। নারায়ণের আশীর্বাদ নিয়ে আরম্ভ হয় দেবীর আরাধনা। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি গেয়ে বিজয়াতে হয় কোলাকুলি। নিরঞ্জনে হয় দেশাত্মবোধক গান।

লাহাবাড়ি

‘মা আছেন?’

ভেতর থেকে মেয়েরা জানান, ‘মা ঘরেই রয়েছেন।’

লাহাবাড়ির দূর্গা স্বামী সোহাগে সোহাগিনী। তাই শিবের ক্রোড়ে বসে থাকেন উমা। লাহা বাড়িতে দেবী হরগৌরি নামে পূজিত। তাই মহিষদলনী নন তিনি। দেবীর হাতে থাকে না অস্ত্রশস্ত্র, থাকেন না মহিষাসুরও। হরগৌরির সঙ্গে একইসাথে পুজো পান এই পরিবারের কূলদেবী অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী মূর্তি জয় জয় মা। পুরনো প্রথা মেনে দূর্গা প্রতিমা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হতে থাকেন একটি ছোট গণেশ। যতদিন পর্যন্ত না প্রতিমার গঠন সম্পূর্ণ হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পূজিত হতে থাকেন সেই গণপতি। এরপর দেবীর সঙ্গে রাখার জন্য যখন গণেশ তৈরি করা হয়ে যায় তখন তাঁর পেটের মধ্যে রেখে দেওয়া হয় ছোট গণেশটি। নবমীর দিন মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় খই, মুড়কি ও মিষ্টি দিয়ে ‘কোল হাঁড়ি’। এই বাড়ির আরও একটি নিয়ম রয়েছে। প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য বাড়ি থেকে বের করে নেওয়ার পর বাড়ির মেয়েরা দরজা বন্ধ করে দেন। পুরুষরা নিরঞ্জন শেষে ফিরে এসে দরজার বাইরে থেকেই তিনবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘মা আছেন?’ ভেতর থেকে মেয়েরা জানান, ‘মা ঘরেই রয়েছেন।’ তারপর খুলে দেওয়া হয় দরজা।

শীল বাড়ি- প্রতিদিন ২৮ কেজির নৈবেদ্য নিবেদন

শীলবাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল সকলের জন্য। এই পরিবারের প্রবাদপ্রতীম পুরুষ ছিলেন মতিলাল শীল। তিনি পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী। এদিকে তখন শোভাবাজার রাজবাড়িতে ধুমধাম সহকারে পুজো হচ্ছে। অথচ সেখানে উচ্চবর্গীয় ও লাল মুখ সাহেব ছাড়া প্রবেশের অনুমতি নেই কারও। ফলে সাধারণ মানুষ পুজোর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতেন। তাই সর্বসাধারণের জন্য শুরু হল শীল পরিবারের দূর্গাপুজো। শীল বাড়ির বউদের গয়নার মধ্যে থাকতেই হবে মল ও নথ। এই বাড়ির প্রতিদিনের নৈবেদ্য হয় ২৮ কেজি।

মিত্রবাড়ির পুজো- গয়লার স্ত্রীকে প্রণাম করে বাড়িতে আসেন সদস্যরা

নীলমণি মিত্র’র বাড়ির পুজো মিত্রবাড়ির পুজো নামে পরিচিত। উনিশ শতকের প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন নীলমণি মিত্র। প্রথম থেকেই এই পরিবারের দেবী প্রতিমার ছাঁচ একইরকম। সন্ধিপুজোতে পদ্মের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় ১০৮ অপরাজিতা। সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে বিসর্জনের আগে মাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর হয় বিসর্জন। নিরঞ্জনের পর বাড়ি ঢোকার আগে কোনও গয়লার স্ত্রীকে প্রণাম করে বাড়ির সদস্যদের বাড়ি ঢুকতে হয়।

শোভাবাজার রাজবাড়ি- বলি দেয়া হয় মাগুর মাছ

শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় অন্নভোগের নিয়ম নেই। রাজা নবকৃষ্ণ দেব কায়স্থ ছিলেন, তাই এই নিয়ম জারি। বর্তমানে এই বাড়িতে দুটি পুজো হয়। দুটি পুজোয় একচালার প্রতিমার। বলি দেয়া হয় মাগুর মাছ। আগে কামান দেখে তবে সন্ধিপুজো হত। বর্তমানে কামান না থাকলেও বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়। পুজোর দায়িত্বে থাকে ওড়িষা থেকে আসা ব্রাহ্মণেরা। হাতির পিঠে চেপে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো দেখতে এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here