ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে দুর্গাপুজো আয়োজিত হয়। গ্রাম বাংলায় আগমনীর আগমনের চিত্রটা আবার অন্যরকম। বর্তমানে জাত পাত নিয়ে তুলনামূলক উদার হয়েছে মানুষ। বছর চল্লিশ পিছিয়ে গেলেও ছবিটা আজকের মতো ছিল না। এই যেমন বাঁকুড়ার পাত্রসায়ের গ্রামের কথাই ধরা যাক না। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে এখানকার সুবর্ণবণিক বংশীয়রা দুর্গাপুজোয় অংশ নিতে পারতেন না।
পাত্রসায়র মূলত ছিল মল্লরাজাদের অধিকৃত জমি। দ্বারকেশ্বরের নদী উপত্যকায় যে ভূমের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল তাই মল্লভূম নামে পরিচিত। আদি রঘুনাথ মল্ল ছিলেন মল্লভূমের প্রথম রাজা। মল্লরাজ জয় মল্লের আমলে বিষ্ণুপুর মল্লভূমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। অতঃপর, পাত্রসায়েরও হয়ে ওঠে মল্লভূমেরই অংশ বিশেষ। এর ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় মল্লরাজারা এই এলাকায় হাজার বিঘে জমি তত্ত্বাবধানের জন্য খাস লোক নিয়োগ করেন। কালে কালে রাজার সেই সব খাস লোকেরা পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘হাজরা’ সম্প্রদায় নামে। সেই সময় হাজরা, ঘোষাল এবং দত্ত তিন জমিদার পরিবার দূর্গাপুজো শুরু করেন। ঘোষাল এবং হাজরারা ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভূক্ত, দত্তরা গন্ধবণিক সম্প্রদায়ভুক্ত। একই এলাকায় বসবাস ছিল বেশ কিছু সেন, পাল, দে, মল্লিক, শীল, আঢ্য, ধর, পাইনদের মতো বেশ কিছু সুবর্ণবণিক পরিবারের। বৈদিক যুগের ভারতীয় সমাজ বিভক্ত ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বর্ণে। সুবর্ণবণিকরা ছিলেন শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। তাই সোনার বেনে পরিবারগুলির উচ্চবর্ণের অনুষ্ঠিত শারদোৎসবে সামিল হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলে চারদিকে যখন কাশের হিন্দোল, ঢাকের বাদ্যি, তখন সুবর্ণবণিক পরিবারের সদস্যদের মুখে বিষাদের ছায়া। মা তো সবার, তাহলে ভেদাভেদ কেন? গলা তুলে প্রশ্ন করারও সেদিন কেউ ছিল না। তবুও মা এলেন ওঁদের কাছে।
সুবর্ণবনিক সম্প্রদায়ের ১৫৬টি পরিবার আজ থেকে ৩৩ বছর আগে শুরু করলেন আনন্দিতার আবাহন। পুজো শুরু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন স্বর্গীয় শচীনন্দন দে, স্বর্গীয় রঞ্জিত সেন, কালীপদ দে প্রমুখ। সময়ের সঙ্গে পুজোর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে থাকার মানুষ কমেছে। বর্তমানে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের দূর্গাপুজোর মূল দায়িত্বে থাকেন গৌতম সেন, মেঘনাথ সেন, অরূপ রতন দে, গোপাল দে প্রমূখ ব্যক্তিত্ব।
একচালার প্রতিমা নয়, সাবেকি মূর্তিতে দেবীর আরাধনা করে সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো করে মায়ের গায়ে প্রথম মাটি ছোঁয়ানো হয়। মহালয়াতে হয় চক্ষুদান। সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান হয়। অষ্টমীতে সন্ধিপুজোয় মায়ের উদ্দেশ্যে দান করা হয় ১০৮ টি পদ্ম। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের পুজোতে রক্তবলি প্রথা নেই। তাই মাষকলাই বলি দেওয়া হয়। দ্রোণ পুষ্প, চন্দন কাঠ ব্যবহৃত হয় সন্ধিপুজোয়। নবমীতে হয় হোম। প্রতি বছর সুবর্ণবনিক সমাজের পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দশমীর ঘট বিসর্জনের পর থাকে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। সন্ধ্যায় প্রতিমা নিরঞ্জন। সব মিলিয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনার বেনের দুর্গোৎসব।