রাত পোহালেই মহালয়া। জঞ্জালের স্তূপে পড়ে থাকা রেডিও আজ হয়ে উঠেছে একদিনের রাজা। তার ব্যাপারই আলাদা! মহালয়ার ভোরে যেটি না শুনলে বাঙালির অস্তিত্বগত সন্দেহ জাগ্রত হয়, সেই ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ শোনার জন্যই এত কষ্ট করে রেডিওর পরিচর্যা।
নেতাজী, সত্যজিৎ, মৃণাল, বিভূতিভূষণ, উত্তম, হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, সৌরভ, ইলিশ, চিংড়ি, রসগোল্লা, দূর্গাপুজো মতো বাঙালির যে কয়েকটি গর্ব করার মতো বিষয় রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও ‘মহিষাসুরমর্দিণী’। মাছে-ভাতে বাঙালির নস্টালজিয়ার এখানেই সমাপ্তি।
মহালয়া নিয়ে প্রত্যেকেরই কম-বেশি স্মৃতি রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার সোপানে পা দেননি এমন কোনও বাঙালি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছেলেবেলার মহালয়া আমাদের অধিকাংশেরই কেটেছে দূরদর্শনে চোখ রেখে। টিভিতে স্টার জলসা, জি বাংলা’র মতো হাজারো বেসরকারি চ্যানেলের তখন কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ডিডি ন্যাশনাল, ডিডি মেট্রো এবং ডিডি বাংলা’ই ছিল ভরসা। সেই ডিডি বাংলায় ভোর সাড়ে ৫’টায় জীবন্ত দূর্গা হয়ে ধরা দিতেন সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী হালদাররা। মনে আছে, এক বছর হেমা মালিনীও অভিনয় করেছিলেন দূর্গা চরিত্রে। কাক’কে ময়ূরপুচ্ছ পরালেই তো কাক ময়ূর হয় না! অসামান্য সুন্দরী হেমা মালিনীর মধ্যে ছা’পোষা বাঙালি ঘরের লড়াকু মেয়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাননি আপামর দর্শককুল। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আবার ঘরের মেয়ে সংযুক্তা ফিরেছিলেন ঘরে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘রূপং দেহি জয়ং দেহি’র আক্ষরিক প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিলেন যেন তিনি।
বড় হওয়ার পর একাধিক বেসরকারি চ্যানেলে মহালয়া হয়েছে, আজও হচ্ছে। সত্যি বলতে, সে’সব একেবারেই মন টানে না। উৎকট মেক আপের ভারে জর্জরিত দেবীশক্তি’র আরাধনা করার থেকে সাদামাটা ত্রিনয়নীই বাঙালির বড় কাছের। জিমে যাওয়া মহিষাসুরের থেকে পুরু গোঁফ, ইয়া বড় ভুঁড়ি নিয়ে লড়তে আসা ‘মহিষ রাজা’ই আমাদের বড় প্রিয়।
আমার কৈশোর কেটেছে মামারবাড়ি কল্যাণী’তে। যাঁরা কল্যাণীতে গিয়েছেন তাঁরা জানেন বিধান রায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত এই শহর অত্যন্ত ছিমছাম, সাজানো গোছানো একফালি ছবির মতো। সেই শহরেই বেড়ে ওঠা আমার। মামারবাড়িতে একটি শিউলি গাছ ছিল। সারা বর্ষা সেই গাছ হয়ে থাকত হাজারো শুঁয়োপোকার আশ্রয়স্থল। শরৎ আসতেই তার রূপ একেবারে অন্য। আকাশে শরতের পুঞ্জীভূত মেঘ জমে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শিউলি গাছের তলা ছেয়ে যেত সাদা ফুলের কার্পেটে। এই দৃশ্যই জানান দিত মা আসছেন। শুরু হত দিন গোনার পালা।
মামার বাড়িতে একটা ঢাউস রেডিও ছিল। রেডিওটি মহালয়ার আগের দিন মামারা ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করতেন। মহালয়ার আগের রাত কাটত নির্ঘুমভাবেই। আমাদের শোওয়ার ঘরে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক ছিল, এখনও রয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় তাঁর ঢং ঢং আওয়াজ জানান দিত সময়ের। আমিও ঠিক চার’টে বাজার অপেক্ষা করতাম। অতঃপর আসত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অনেকক্ষণ জেগে থাকার পর ঠিক যখন একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি তখনই শোনা যেত বহু প্রতীক্ষিত ‘যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী…’। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা…’ জানিয়ে যেত মা এসে গিয়েছেন। এসে গিয়েছে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ নেওয়ার দিন, এসে গিয়েছে ঢাকের বাদ্যি আর পুজোর গানের দিন। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে সূর্য ওঠা দেখতে দেখতে কেটে যেত পাক্কা দেড় ঘণ্টা। যে সুর, যে ভাষ্য না হলে বাঙালির পুজোর কোনও অর্থই থাকে না সেই সুরের ‘আগমনী আলো’র পথে আলতারাঙা পায়ে ঘরে আসতেন উমা। এই চিত্র বহু বছরের। আরও বড় হয়ে যখন কলেজে পড়ি তখন মা, বাবার সঙ্গে বসে ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ শুনতাম। সে স্মৃতিও তো অমলিন!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহালয়ার রূপ বদলিয়েছে। এখন ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ শোনার জন্য বছরভর অপেক্ষা করতে হয় না, ইউটিউবের দৌলতে যখন ইচ্ছা তখনই শোনা যেতে পারে পঙ্কজ মল্লিকের সুরে বাণীকুমারের শ্রেষ্ঠ রচনাটি। তবে তাতে মহালয়ার চার্ম’টা থাকে কি? স্বীকার করতে লজ্জা নেই, থাকে না! একটি নির্দিষ্ট দিন ছাড়া অন্য কোনওদিন যদি ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ শুনতে হয়, যদি ট্রাফিক সিগনালে ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু’ বেজে ওঠে, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ যখন ‘জাগো দুর্গা’ গেয়ে একইসঙ্গে পিয়ানো ও গিটার বাজিয়ে ওঠেন, তখন নিজেকে বাঙালি বলে ভাবতে বড্ড কষ্ট হয়।
আজ মহালয়া আগমন হয় ‘শুভ’ হয়ে নয়, ‘হ্যাপি’ হয়ে। দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব, বাঙালি ধীরে ধীরে তাঁর অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বাংলা বা ইংরেজি নয় ‘বাংরেজি’ এখন তার ভাষা, সুনীল-বিভূতি-তারাশঙ্কর-আশুতোষের থেকে হোয়্যাটস অ্যাপ, ফেসবুকের গল্পতেই সীমাবদ্ধ তার সাহিত্যপ্রীতি। পরের প্রজন্ম হয়তো আমাদের মতো মহালয়া শোনার জন্য ব্যাকুলও হবে না।
মহালয়ার পাশাপাশি পাল্টে গিয়েছে জীবনের গতিপথও। হারিয়ে গিয়েছেন কাছের মানুষেরা। যে মেয়েটা ‘মহিষাসুরমর্দিণী’ শুরু হওয়ার ভোরে ফোনে জানান দিত ‘জেগে আছি দিদি’, তার সঙ্গেও আজ আর যোগাযোগ নেই। তবুও মহালয়া আসে। বয়ে চলা স্মৃতির ঢেউয়ে পাল বাইতে তার আগমন।
এত কিছুর পরেও প্রতি বছর মহালয়া আসবে জীবনে নতুন আশার সঞ্চার নিয়ে। যতদিন আকাশে সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান থাকবে, যত দিন বাঙালির জীবনে শারদোৎসব আসবে, তত দিন মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিণী আসবেন একইভাবে। সব বাড়িতে ভোরে রেডিও চলবে না, সবাই ঘুম থেকেও উঠবেন না, তবুও মহালয়ার বাজনা বাজবে। এখানেই বাঙালি ব্যতিক্রমী।