নিজের মনকে ভাল রাখতে আত্মশুদ্ধির পথে হাঁটবেন বলে ঠিক করেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে ভাবে চলছে, সে ভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না! সব কিছু শুরু করবেন নতুন করে। কিন্তু আশপাশের পরিস্থিতি আর মানুষগুলিই যদি না বদলায়, তবে কি পরিবর্তন আদৌ সম্ভব? পরিপার্শ্বকে বদলাবেন কী করে? সাহিত্যিক তথা দার্শনিক লিও টলস্টয় এর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘পৃথিবীকে বদালানোর কথা সবাই ভাবে, কিন্তু কেউ নিজেকে বদলাতে চায় না।’’ একই কথা জানাচ্ছেন মনোবিদেরাও। তাঁরা বলছেন, ‘‘আগে নিজেকে বদলান। কাজটা কঠিন। কিন্তু করে ফেলতে পারলে আর পিছু ফিরে দেখতে হবে না।’’

কিন্তু, নিজেকে বদলাবেন কীভাবে? আমেরিকার মনোবিদ অ্যালবার্ট এলিস বলছেন, ‘‘প্রথম পদক্ষেপ হল নিজের বদঅভ্যাসগুলোকে চিহ্নিত করা। সেগুলো যে খারাপ অভ্যাস, সেটা অনুভব করা এবং সেই অভ্যাসের জন্য অন্য কাউকে দোষী না ঠাউরে নিজেই নিজের ভাগ্য নির্ধারনের দায়িত্ব নেওয়া। যে দিন সেটা করতে পারবেন, জানবেন, অর্ধেক যুদ্ধ সেখানেই জেতা হয়ে গিয়েছে।’’ দৈনন্দিন জীবনের এমন আটটি বদভ্যাসের কথা বিশেষ ভাবে বলেছেন মনোবিদেরা।

১। কল্য করিব বলিয়া

বর্ণপরিচয়েই ওই শিক্ষা দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর— ‘‘কল্য অভ্যাস করিব বলিয়া রাখিয়া দিবে না। যাহা রাখিবে আর তাহা অভ্যাস করিতে পারিবে না।’’ আধুনিক মনোবিদেরাও তা-ই বলছেন। তাঁদের কথায়, কাজ ফেলে রাখার অভ্যাসকে অনেকেই সে ভাবে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু এটি আত্মশুদ্ধির পথে প্রথম অন্তরায়। কমবেশি কাজ ফেলে রাখার বদভ্যাস রয়েছে অনেকেরই। অপছন্দের কাজ বা আপাতদৃষ্টিতে কোনও কাজ কঠিন মনে হলেই একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হয়, সেই কাজ না করার বা ‘পরে করব’ বলে ফেলে রাখার। এলিস বলছেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, যে কোনও কাজই আদতে এক একটি উন্নতির সুযোগ। যত কাজ করবেন, ততই নিজেকে উন্নত করার সুযোগ পাবেন। কঠিন কাজ ফেলে রাখা বা চ্যালেঞ্জ না নেওয়ার অর্থ আপনি নিজেই উন্নতির সুযোগকেই পায়ে ঠেলছেন।’’

২। হবে না, হচ্ছে না

অনেকেই মনে করেন, আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। কিন্তু মনোবিদেরা বলছেন, এই সমালোচনা বাড়তে বাড়তে একটা সময় আত্মপীড়নের পর্যায়েও পৌঁছে যায়। তখন নিজের করা কোনও কাজই আর নিজের পছন্দ হয় না। অনেকে এই মনোভাবকে ‘পারফেকশনিস্ট’ বলে ভুল করেন। কিন্তু আদতে বিষয়টা হল নেতিবাচক মনোভাব। এই ধরনের মনোভাব ভাল করার বদলে অনেক সময়ে আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করতে পারে। তাই যখনই এমন মনে হবে, পাল্টা ইতিবাচক কোনও ভাবনা ভাবুন। দ্রুত নিজের মধ্যে বদল দেখতে পাবেন।

৩। বড্ড ইগো’!

কঠিন ‘রোগ’। কিন্তু এর থেকে মুক্তি না পেলেই নয়। ইগো বা আত্মম্ভরিতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইগো হল সেই ভাবনা, মাথার মধ্যে কথা বলতে থাকা সেই কণ্ঠস্বর যে সমস্ত ভালর কৃতিত্ব নেয় আর সমস্ত ব্যর্থতার জন্য অন্যদের দায়ী করে। আড়ালে থাকা ওই কণ্ঠস্বর সব সময় চায় ঠিক প্রমাণিত হতে। তার মূল্য দিতে গিয়ে যদি কোনও সম্পর্ককে বিদায় জানাতে হয়, তবে তাতেও দ্বিধা করে না। এই অহংবোধই আমাদের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। অহংবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়। বৌদ্ধধর্মে অহংবোধ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে বলা রয়েছে— আগে মানতে হবে আপনি নিখুঁত নন। ভুল আপনিও করতে পারেন। দুর্বলতা থাকতেই পারে। সবার থাকে। সেটা খারাপ কিছু নয়। মনোবিদ কার্ল রজার্স বলছেন, ‘‘পরিবর্তনের চাবিকাঠিই হল নিজেকে নিজের দোষ-গুণ সমেত মেনে নেওয়া। মানতে পারলে তবেই বদলাতে পারবেন।’’

৪। মাল্টিটাস্কিং

গতির দুনিয়া। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময়েই এক সঙ্গে একাধিক কাজে মাথা দিতে হয়। কাজ উতরেও দিতে হয়। একসঙ্গে অনেক কাজ উতরে দেওয়ার এই ক্ষমতা বা ‘মাল্টিটাস্কিং’কে এখনকার কর্মক্ষেত্রে ‘গুণ’ হিসাবেই দেখা হয়। কিন্তু মনোবিদেরা বলছেন, আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে এটি আদতে কোনও গুণ নয়, বরং উন্নতির পথে তা বাধারই সৃষ্টি করে। এতে কাজের ক্ষমতা এবং মান যেমন কমে, তেমনই মানসিক চাপ তৈরির সম্ভাবনাও বাড়ে। কোনও একটি কাজে মনসংযোগ করতে না পারার কারণেই এমনটা হয় বলে মনে করেন স্নায়ুবিজ্ঞানী আর্ল মিলার। তিনি বলছেন, ‘‘যদি কেউ বলেন, তিনি খুব ভাল মাল্টিটাস্কিং করতে পারেন, তবে তিনি আদতে নিজেকেই ভুল বোঝাচ্ছেন। কারণ, একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারা মানুষের মস্তিষ্কের সহজাত ক্ষমতা নয়।’’ তাই অনেক কাজ একসঙ্গে করার বদলে এক বারে একটি কাজেই মনসংযোগ করুন। পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন।

৫। প্ল্যানিং ইজ় এভরিথিং?

পরিকল্পনা করে এগোনো ভাল। সে ক্ষেত্রে কোন দিকে এগোতে হবে, কতখানি এগোতে হবে, সে ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু অতি-পরিকল্পনারও কিছু সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, পরিকল্পনা করতে গিয়ে কাজটাই ঠিক করে করা হল না। অতি-পরিকল্পনা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাতেও লাগাম পরায়। অনেক ক্ষেত্রে বহু অযাচিত সুযোগ তৈরি হয় কোনও হঠাৎ বদল বা ঘটনার কারণে। তাই মনোবিদেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সবচেয়ে ভাল পরিকল্পনা হল, কোনও পরিকল্পনাই না থাকা। সে ক্ষেত্রে যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করার একটা মনোভাব তৈরি হবে। যা আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে।

৬। ডরকে আগে জিত

স্বাচ্ছন্দ্য কার না পছন্দ! প্রত্যেকে তাঁদের স্বাচ্ছন্দের ক্ষেত্রেই থাকতে ভালবাসেন। কারণ ভয়। নিরাপত্তার ভয়ই আমাদের চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে দেয় না। এ ক্ষেত্রে এক নরম পানীয়ের বিজ্ঞাপনের স্লোগান দিশা দেখাতে পারে— “ডরকে আগে জিত হ্যায়!” মনোবিদেরাও তা-ই বলছেন। তাঁদের মতে, অস্বাচ্ছন্দ্যকে এড়িয়ে চলার অর্থ হল নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন ঝুঁকি বা নতুন অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। তাতে ব্যক্তিগত উন্নতিই বাধা পায়। সুযোগও আসে কমে। মনোবিদ সুজ়ান জেফার্সের টোটকা, ‘‘ভয়কে অনুভব কর। তার পরে যে ভাবে হোক, কাজটি সেরে ফেল। অস্বাচ্ছন্দ্যের ও পারেই কিন্তু উন্নতি দাঁড়িয়ে রয়েছে।’’

৭। তোমার তুলনা তুমিই

সমাজমাধ্যমে অজস্র মানুষের কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবন, বান্ধব পরিসরের ছবির ছড়াছড়ি। সে সব দেখে নিজের যোগ্যতা বা প্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে। কিন্তু, এই তুলনা অবান্তর। তার কারণ, প্রত্যেকটি মানুষের সফর আলাদা। তাঁদের অভিজ্ঞতা আলাদা। তাঁদের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। নিজেকে অন্যের মাত্রায় তুলনা করলে তাই মন্দ বই ভাল হবে না। আত্মবিশ্বাস কমবে। নিজের উন্নতি নিয়ে মনে সন্দেহ তৈরি হবে। তার থেকে নিজের সাফল্যকে উদ্‌যাপন করুন। নিজের উন্নতিতে মন দিন।

৮। আপ ভাল তো জগৎ ভাল

উন্নতির দিকে নজর দিতে গিয়ে অনেকেই নিজের যত্ন নিতে ভুলে যান। কিন্তু আত্মশুদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল নিজেকে অগ্রাহ্য না করা। নিজেকে সময় দিন। নিজের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার উপর জোর দিন। এমনকি, নিজের আবেগেরও যত্ন নিন। ভাল খাওয়া, ভাল ঘুম ছাড়াও ভালত্বে উত্তরণ সম্ভব নয়। নিজেকে ভাল রাখার জন্য এমন কিছু করুন, যা আপনাকে আনন্দ দেয়। মনোবিদ আব্রাহাম মাসলো বলছেন, ‘‘জীবনে পরিবর্তনের জন্য সবার আগে জরুরি নিজেকে জানা।’’ আর তার শুরুটাই হয় নিজের যত্ন নেওয়া থেকে।

এই আট অভ্যাসকে বদলানো হল আত্মশুদ্ধির প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কাজটা একেবারেই সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা আসতে পারে। ভুল হতে পারে। গণ্ডগোল হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কতটা নিখুঁত হচ্ছে, সেটা বিষয় নয়, আপনি কতটা এগোতে পারলেন সেটাই হল বড় কথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here