শ্রীমদ্ভগবত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগ নামে পরিচিত। তাঁর ৫২তম শ্লোকে ‘কলিল’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ দলদল বা চোরাবালি। বুদ্ধির প্রসঙ্গে এই কলিল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধিব্যর্তিতরিষ্যতি।

তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।

অর্থাৎ, যে সময় তোমার বুদ্ধি মোহরূপী চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে, সে সময় তোমার শুনে থাকা এবং যা শুনবে তা ভোগ করা থেকে বৈরাগ্য লাভ করবে।

‘যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধিব্যর্তিতরিষ্যতি’— আমার নিজের শরীর আছে, আমি সৌন্দর্যের অধিপতি, এই চিন্তাধারা শরীরের প্রতি অহংকার বা এই শরীর এমনই যুব, আকর্ষক এবং কমনীয় থাকবে, এমন চিন্তা শারীরিক অহং ও মমতা। মা-বাবা, দাদা-বউদি, স্ত্রী-পুত্র, বস্তু, পদার্থের প্রতি আসক্ত থাকাই হল শরীরের আশ্রম থেকে উৎপন্ন মমতা। শরীরে না-তো অহং থাকে ও না মমতা। এটি নিজের সময়ের গতির সঙ্গে আবির্ভূত, পরিবর্ধন, জরা ইত্যাদি স্বীকার করে একদিন তিরোভাব লাভ করবে। এ ভাবে এই শরীর অহং এবং মমতা থেকে মুক্ত। এই অহং এবং মমতা আমাদের দ্বারা কল্পিত ও স্বীকৃত। ব্যক্তি নিজের মনোনুকূল বস্তু, ঘটনা ইত্যাদি লাভ করলে আমরা প্রসন্ন হই। আবার নিজের দ্বারা কল্পিত মনোনুকূল পরিস্থিতি লাভ হলে দুঃখী, চিন্তিত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সংসার ও তার কার্য ব্যাপারে পরিবর্তন, পরিবারে বিষমতা, পক্ষপাত, মুখাপেক্ষী এবং মাৎসর্য ইত্যাদির বিকারই কলিল অথার্ৎ চোরাবালি। এই মোহরূপী চোরাবালিতে বুদ্ধি আটকে গেলে দিগভ্রমিত হয়ে কৃত ও অকৃত কর্মের নির্ণয় করতে পারে না। একেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার পরিস্থিতি বলা হয়। এমন দশায় ব্যক্তি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

এই আত্মা সদা সর্বদা নির্লিপ্ত। আমাদের শরীর ইত্যাদির অহং ও মমতার আধার নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং তার প্রতি নিজের সুখ-দুঃখের অনুভূতি করতে শুরু করে। যে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে তা তাদের সঙ্গে থাকবে না, তা জানা সত্ত্বেও এই অনুভূতি হয়ে থাকে। অন্য দিকে শরীরও তাদের সঙ্গে সর্বদা থাকে না। কিন্তু মোহের কারণে এই সত্য পক্ষকে সে দেখতে পায় না বা দেখলেও তা উপেক্ষা করে যায়। সে সংসার বা তার কার্যব্যবসার সঙ্গে নিত্য নতুন সম্পর্ক জুড়ে মাকড়সার মতো নিজেরই বোনা জালে জড়িয়ে পড়তে থাকে। এটিই এই বুদ্ধির মোহরূপী কলিল অর্থাৎ চোরাবালিতে আটকে যাওয়া।

আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত যে আমরা আত্মকল্যাণের জন্য এসেছি এবং তা-ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তাই এই চোরাবালিতে আটক না-পড়ে নিজের কল্যাণ করা উচিত। এই আপ্ত সত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হওয়াই মোহরূপী চোরাবালি থেকে বেরিয়ে আসা। বুদ্ধি সংসারের আকর্ষণ-বিকর্ষণে আটকা না-পরলেই সংসারের আসক্তি দূর হয়ে যাবে।

মোহরূপী কলিল থেকে বেরিয়ে আসার জন্ গীতায় দুটি উপায় বর্ণিত রয়েছে— একটি বিবেক এবং অপরটি হল সেবা।

গীতায় বিবেকের প্রভাব বর্ণনা করার জন্য বলা হয়েছে—

অশোচ্যান্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।

গতাসুনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ।।

এর পর আর একটি শ্লোকে এ বিষয় বুঝিয়েছেন কৃষ্ণ

দেহী নিত্যমবধ্যোয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।

তস্মাতসর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।

বিবেকে একটি তেজ থাকে যা অসত্যের প্রতি অনাসক্তি সৃষ্টি করে।

দ্বিতীয় উপায় হল সেবা। এই আসক্তিকে দূর করার দ্বিতীয় শক্তি হল সেবা। ব্যক্তির মধ্যে বিশ্রাম, সুখভোগ ইত্যাদি ইচ্ছার পরিত্যাগ করার শক্তি থাকে।

 

কর্মযোগীদের মধ্যে সংসারের সেবার ইচ্ছা হৃদয়ে উৎপন্ন হলে সুখ ভোগের ইচ্ছা নিজে থেকেই সমাপ্ত হয়ে যায়।

বিবেক ও বিচার দ্বারা নিজের ভোগেচ্ছা ত্যাগ করতে সময় লাগে এবং কঠিনও হয়। এর কারণ বিবেক ও বিচার যদি দৃঢ় না-হয়, তা হলে তা ততক্ষণ বিষয় থেকে মুক্ত থাকে। কিন্তু যখনই এই ভোগ সামনে আসে, তখন বিবেক পথচ্যুত হয়। তাই এ ক্ষেত্রে দৃঢ়তার সঙ্গে বিচারধারার পুষ্ট হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক ও অপরিহার্য।

সেবার চিন্তাধারায় ত্যাগ বৃত্তি প্রমুখ। যে কারণে, কোনও ভোগ ব্যক্তির সামনে এসে গেলে, তা অন্যের সেবায় প্রস্তুত করে দেয়। এ ভাবে তাঁর সুখ ও বিশ্রামের ইচ্ছা সহজে মিটে যায়। তাই যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ সাংখ্য যোগ অপেক্ষা কর্মযোগকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here