দুর্গাপুজোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার নবপত্রিকা স্নান। এই নবপত্রিকাকে কলা বউ বলেও অভিহিত করা হয়। লোকমুখে প্রচলিত কলা বৌ হলেন গণেশের স্ত্রী। কোনও কোনও পুরান মতে গণেশের স্ত্রী ষষ্ঠী। আবার কারও মতে ষষ্ঠী কার্তিকের স্ত্রী। তাহলে গণেশের পাশে যিনি থাকেন তিনি কে?

আসলে প্রাচীনকালে মানুষের কাছে গাছ গাছড়া ছিল উপাস্য দেবতার সমান। এইসব গাছগাছড়াগুলি ছিল ওষধি গুণ সম্পন্ন। কলাবৌ বা নবপত্রিকা বলে যা পরিচিত তা আসলে নয় রকমের গাছের সমাহার যাদের থেকে ওষধি ও খাদ্যগুন দুই-ই পেয়েছিল মানুষ। আজ জেনে নেওয়া যাক নবপত্রিকার সেই গাছগুলির নাম।

নবপত্রিকার প্রথম গাছটি হল কলা। কলা অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। একসময় ভারতে পালাজ্বরের আয়ুর্বেদ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত কলা। যকৃত, অগ্ন্যাশয়, কিডনি ভাল রাখতে সাহায্য করে কদলী। সব মিলিয়ে কদলীর গুণ প্রচুর।

দ্বিতীয় হল কচু। কচুর খাদ্যগুণ না থাকলেও কিডনি রক্ষায় সাহায্য করে।

তৃতীয় হল হরিদ্রা অর্থাৎ হলুদ। হলুদ মশলার পাশাপাশি বিষক্রিয়ানাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কাঁচা হলুদে চর্মরোগ সারে৷ তবে অতিরিক্ত কাঁচা হলুদ সেবনে প্রাণনাশের সম্ভাবনা থাকে।

তারপর আসে জয়ন্তী৷ জয়ন্তীর ব্যবহার ওষুধে। আগে ভারতভূমিতে ভীষনভাবে কুষ্ঠরোগের প্রকোপ ছিল। চামড়ায় যে সাতরকমের কুষ্ঠরোগ হয় তার মধ্যে চার রকমের ওষুধই হচ্ছে জয়ন্তী৷ স্বভাবতই জয়ন্তীও পুজিত হত।

এরপর অশোক। অশোক গাছ স্ত্রীরোগ নিরাময়ের জন্য খুবই ভাল ওষুধ৷ পুরাকালে অশোক থেকে এক ধরনের মদ তৈরি হত। তাকে বলা হও অশোকারিষ্ট।

সাতে আসে বিল্ব অর্থাৎ বেল। পেটের রোগের খুব ভাল ঔষধ হিসেবে কাজ করে বেল৷ কাঁচা বেল পুড়িয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভাল। পাকা বেলের থেকে কাঁচা বেল অনেক বেশি উপকারি।

তারপর আসে দাড়িম্ব। দাড়িম্ব শব্দের অর্থ ডালিম। ডালিমের ছাল, শেকড় ও ফুল স্ত্রীরোগের জন্য খুব উপকারি।

অষ্টম স্থানে আসে মান। মান কচু শারীরিক বৃদ্ধিতে উপকারি বন্ধুর ভূমিকা পালন করে। তবে অতিরিক্ত মানসেবনে দেহের উত্তাপ বাড়ে। শরীর কষে গেলে অনেক সময় নাক থেকে রক্ত পড়ে। সেক্ষেত্রে মানের ব্যবহার খুব ভাল।

আর আছে ধান্য। ধান থেকে চাল তৈরি হয়। এই গুণ ছাড়াও পুরাকালে ধান থেকে তৈরি হত বিভিন্ন রকমের মদ। সেই সব মদ থেকে তৈরি হত নানারকমের ওষধি।

শিবোত্তর তন্ত্রের যুগে এই ন’টা গাছকে ধরা হত চণ্ডিকা শক্তির ন’রকমের অভিব্যক্তিরূপে৷ তাই কদলীতে তাঁদের কল্পিত চণ্ডিকা শক্তির অভিপ্রকাশ ঘটেছিল ব্রাহ্মণী শক্তি রূপে৷ কচুতে থাকা শক্তি হয়েছিল কালিকা শক্তি, হরিদ্রায় দুর্গাশক্তি, জয়ন্তীতে কার্ত্তিকী শক্তি, অশোকে শোকরহিতা শক্তি, বিল্বে শিবশক্তি, দাড়িম্বে চণ্ডিকা শক্তির নামকরণ হয়েছিল রক্তদন্তিকা, মান-এ চামুন্ডা আর ধান্যে যে শক্তি, তার নাম লক্ষ্মী৷

ন’রকমের চণ্ডিকাশক্তির মিলিত নামকরণ হয়েছিল নবদুর্গা, আর এই ন’রকম গাছের মিলিত নাম হয়েছিল নবপত্রিকা৷ এই নবপত্রিকার মধ্যে যে কলাগাছ রয়েছে, সেটিকে গণেশের পাশে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়৷ যেন দেখেই মনে হয় একজন বিবাহিতা নারী ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেই থেকেই জনমানসে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয় যে কলাগাছ আসলে গণেশের স্ত্রী। এই ধারণা যে সত্য নয়, তা এই প্রতিবেদনেই পরিষ্কার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here