
সালটা ছিল ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। ব্রিটিশ শাসনাধীনে কলকাতার প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কার্যকলাপে গুঞ্জন উঠেছিল। এই প্রাণকেন্দ্রে তখন কতশত সাহেবপ্রেমী বাঙালিদের আনাগোনা। রাইটার্সে তখনই গর্জে উঠেছিল তিন বাঙালির বন্দুক। সেই গর্জন যুগে যুগে প্রতিধ্বনিত হবে। তাঁরা ছিলেন বিনয়-বাদল-দীনেশ।
বিনয় কৃষ্ণ বসু বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে (পূর্ববর্তী মিডফোর্ড মেডিকেল স্কুল) ভর্তি হন। ঢাকার বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিনয় যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত একটি গুপ্ত সমিতি মুক্তি সংঘে যোগদান করেন।
দীনেশ গুপ্ত ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার জোশোলং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন চলাকালীন ১৯২৮ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু কর্তৃক সংগঠিত একটি দল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগদান করেন।
ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের পূর্ব শিমুলিয়া (পূর্ব শিমুলিয়া) গ্রামে সুধীর গুপ্ত ওরফ বাদল গুপ্ত নিকুঞ্জ সেনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি বিক্রমপুরের বানারীপাড়া স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। তারপরই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে নেন বাদল।
বাদল তার দুই মামা প্রয়াত ধরণীনাথ গুপ্ত এবং নগেন্দ্র নাথ গুপ্তের বিপ্লবী কর্মকান্ড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁরা উভয়েই আলিপুর বোমা মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শ্রী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে কারাবরণও করেছিলেন।
সুভাষ চন্দ্র বসু দ্বারা সংগঠিত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সংগঠনের সদস্যদের উদ্দেশ্য ছিল কুখ্যাত ব্রিটিশ অফিসারদের নির্মূল করার জন্য তাদের অন্বেষণে অগ্রসর হওয়া। ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া ‘অপারেশন ফ্রিডম’-এ বিভিন্ন বাঙালি জেলে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সেই বছরই আগস্টে, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যানকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল। ঢাকার মেডিক্যাল স্কুল হাসপাতালে বিনয় বসু শেষ পর্যন্ত তাকে গুলি করে হত্যা করে কলকাতায় পালিয়ে যায়।
এবার বিনয়, বাদল এবং দীনেশ অত্যাচারী সিম্পসনকে এবং সেইসাথে অন্যান্য ব্রিটিশদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারই পরিণাম হয় অলিন্দ যুদ্ধ।
১৭৭৭ সালে টমাস লিয়ন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেন। এই নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জুনিয়র কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা করা। এইখানেই ডিসেম্বরের এক দিন শুরু হয়েছিল তাণ্ডব। ইউরোপিয় পোশাক পরা তিন যুবক আরাল থেকে গুলিবর্ষণ করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল কর্নেল এন এস সিম্পসন। তিনি ব্রিটিশরা রাজনৈতিক বন্দিদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের জন্য পরিচিত ছিলেন।
ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে এই তিন তরুণ বিপ্লবীর প্রবল গুলিযুদ্ধ শুরু হয়। টোয়াইনাম, প্রেন্টিস এবং নেলসনের মতো ব্রিটিশ অফিসাররা লড়াইয়ে গুরুতর আহত হন।
যদিও ব্রিটিশরা এই ত্রয়ীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিনয়-বাদল-দীনেশ আত্মসমর্পণ করতে চাননি। বাদল গুপ্ত পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন, বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৩০ সালের ১৩ ডিসেম্বর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনজনের মধ্যে দীনেশই জীবিত ছিলেন। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড ও হত্যার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই আলিপুর জেলে ১৯ বছর বয়সে শহিদ হন। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তর স্মৃতিতে ডালহৌসি স্কোয়ারের নামকরণ করা হয় বিবাদি বাগ।