ধর্মীয় মিশেলে পরিপূর্ণ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,

যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা,

যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা

আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা’

ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁর মঙ্গল কামনা করে বাঙালি ঘরে ঘরে পালিত হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। বঙ্গবাসীর ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’র মধ্যে এটি অন্যতম। এই ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কাহিনী।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া নিয়ে ইতিহাস রয়েছে প্রচুর। এমনকী অন্য ধর্মের মধ্যেও রয়েছে ভাইফোঁটার গল্প। জৈন ধর্মের পুঁথি ‘দীপোৎসবকল্প’ থেকে জানা যায় জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর বর্ধমানের প্রয়ানের পর তাঁর সঙ্গী রাজা নন্দীবর্ধন ভেঙ্গে পড়েন। শুরু করেন অনশন। ধীরে ধীরে মানসিক ও শারীরিক ক্ষয় হতে শুরু করে তাঁর। দাদার এমন অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে পড়েন বোন অনসূয়া। তিনি নন্দীবর্ধনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সেদিন ছিল কার্তিকী শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি। এই পবিত্র তিথিতে অনসূয়া ভাইয়ের কপালে এঁকে দেন রাজতিলক, খাবার খাইয়ে নন্দীবর্ধনকে বলেন তিনি রাজা, প্রজারা তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তাই এমন অনশন কি একজন রাজাকে মানায়? “তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করি। প্রতি বছর এইদিনে তোমাকে রাজতিলক পরিয়ে অভিষিক্ত করা হবে, এই আমার ব্রত।”-এইভাবেই নন্দীবর্ধনকে ভাইফোঁটা দিয়ে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ব্রত’র পালন করেছিলেন অনসূয়া। এই গল্প যদি শুধুই গল্প না হয় তাহলে বলা যায় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসব জনমানসে শুরু হয়েছিল ৫২৭ অব্দে।

ভারতীয় পুরাণ আবার ভ্রাতৃদ্বিতীয়া প্রসঙ্গে নিয়ে এসেছে সূর্যপুত্র-কন্যা যম ও যমুনাকে। সূর্যদেবের তিন স্ত্রী সংজ্ঞা, প্রভা ও রজনীর মধ্যে সংজ্ঞার সন্তান ছিলেন মনু ও যম। কন্যা ছিলেন যমুনা। ‘মৎস্যপুরাণ’ মতে শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের সঙ্গে বিয়ের আগে যমুনা ফোঁটা দিয়েছিলেন মনু ও যমকে। সেই জন্যই নাকি প্রচলিত হয়েছিল ভাইফোঁটা।

ভাইদের মঙ্গল কামনা করে, দীর্ঘায়ু কামনা করে হওয়া ভ্রাতৃদ্বিতীয়া সারা ভারতে বিভিন্ন নামে পরিচিত। কোথাও ভাইদুজ, কোথাও ভাইটিকা, কোথাও বা ভাইবিছিয়া। মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, গোয়ায় চালের গুঁড়ো দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়, যাকে চৌকনা, চতুর্কোন, চোকনা বা চুকনা বলা হয় অঞ্চলভেদে। সেখানে বসেই ফোঁটা সমাধা করেন বোনেরা। নেপালে আবার ঘুমন্ত ভাইয়ের কপালে পোড়া চালের ফোঁটা দিয়ে ভাইফোঁটা সারেন বোনেরা। তাঁরা মনে করেন এতে ভাইয়ের জীবনে কখনও কোনও অশুভ সময় আসবে না।

বাংলায় দই, চন্দন, মধু, ঘৃত ও শিশিরের জল দিয়ে ভাইদের কপালে ফোঁটা দেন বোনেরা। মঙ্গল কামনা করে বছর বছর অনুষ্ঠিত হয় ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here