নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যক্তিত্ব, কাজ সাধারণ মানুষকে মহান নেতার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও সমানভাবে অনুসন্ধিৎসু করে তুলেছিল। অথচ তাঁর বিবাহিত জীবন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। নেতাজির বিবাহিত জীবন নিয়ে প্রাপ্ত তথ্য তাবড় তাবড় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকেও দ্বিধাবিভক্ত করেছে।

মোদি সরকারের প্রকাশিত ফাইলগুলিতে ‘এমিলি শেঙ্কল’ নামে এক নারীকে নেতাজির স্ত্রী এবং অনিতা বোস প্যাফকে তাঁর কন্যা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতি প্রদানের বিষয় নিয়ে গুরুতর আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল।

একটি নথি অনুসারে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ১৯৮০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও), বিদেশ মন্ত্রক এবং গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখাকে চিঠি দিয়ে বলেছিল যে তাদের কাছে ‘নেতাজির বিবাহের’ বা ” কন্যাসন্তান জন্মনোর কোনও রেকর্ড নেই”।

বিদেশী মহিলার সঙ্গে নেতাজির বিবাহ বা সেই বিবাহের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তানের জন্মের বিষয়ে মন্ত্রকের কোনও রেকর্ড নেই। গোয়েন্দা ব্যুরোর সঙ্গেও পরামর্শ করা হয়েছে, তাঁদের কাছে এই বিষয়ে কোনও রেকর্ড নেই, সরকারি তরফে বিনয় বশিষ্ঠ স্বাক্ষরিত চিঠিটি পড়া হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল টি.এন. সিং অনিতা প্যাফের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন যার সঙ্গে তিনি রাজভবনে দেখা করেছিলেন।

নেতাজির বিয়ে নিয়ে গুরুতর সন্দেহ উত্থাপন করে অল ইন্ডিয়া ফ্রিডম ফাইটারস সমিতির সদস্য অরুণ ঘোষের একটি চিঠির এই বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়।

অন্য একটি নথি অনুসারে, ১৯৭৮ সালে পিএমও এমিলি শেঙ্কলকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বিধবা স্ত্রী এবং অনিতা শেঙ্কল প্যাফকে নেতাজির কন্যা বলে নিশ্চিত করেছিল।

ফাইলটিতে লিখিত ছিল:

এটা স্বীকার করা হয়েছে যে এমিলি শেঙ্কল ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর বিধবা স্ত্রী এবং তাঁদের কন্যা অনিতা শেঙ্কল।

সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিবারের সদস্যরাও তা মেনে নিয়েছিলেন।

অনিতা শেঙ্কল প্যাফ (বসু) ১৯৬০ সালে ভারত সফর করেন এবং কিছু সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আতিথ্য লাভ করেন।

অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অনিতাকে বাৎসরিক ৬,০০০ করে টাকা পাঠাতো।

১৯৬৩ সালের নভেম্বরের আর একটি চিঠিতে, নিজের স্ট্যাম্পযুক্ত স্বাক্ষর সহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জানিয়েছিলেন যে তিনি নেতাজির বিয়ে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী জানতেন জার্মানি বা অস্ট্রিয়াতে সুভাষ বিয়ে করেছেন।

আরও একটি নথি রয়েছে যেখানে ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে হরিপদ বসু নেহরুকে চিঠি লিখেছিলেন যে নেতাজির সঙ্গে এমিলি শেঙ্কলের বিবাহ এবং তাঁদের কন্যার জন্মের শংসাপত্রের কোনও সরকারি রেকর্ড রয়েছে কিনা।

চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত স্মারকলিপিতে সই করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব এম.এল. বাজাজ। সেখানে বলা হয়েছিল হরিপদ বসুর চিঠি স্বীকৃত হয়নি।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে প্রকাশিত ‘নেতাজির সহধর্মিনী’ বইটিতে লেখক শেখর বসু বিয়ের তারিখ উল্লেখ করেছেন ১৯৪১। কিন্তু জয়শ্রী প্রকাশনের বিরুদ্ধে করা মামলায় নেতাজির ভাইপো শিসির বসু ১৯৭৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে জমা দেওয়া হলফনামায় বলেছিলেন যে সুভাষ ১৯৪২ সালে এমিলিকে বিয়ে করেছিলেন। আবার, ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে প্রকাশিত ‘ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্য রাজ’ বইতে লেখক লিওনার্ড গর্ডন বলেছেন যে বিয়ে হয়েছিল ১৯৪১ সালে। অবশেষে, নেতাজির সংগৃহীত রচনাগুলির সপ্তম খণ্ডের সম্পাদকদের ভূমিকায়, শিশির এবং তাঁর ছেলে সুগত বসু লিখেছিলেন যে বিয়ে হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর। কোনটি সত্য? নাকি নেতাজির বিরুদ্ধে নেহেরু-মাউন্টব্যাটেন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে এটি একটি হাতিয়ার?”

নেতাজির ভাইঝি রোমা বলেছেন যে এমিলি ১৯৪৯ সালে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের সময় ভিয়েনা বিমানবন্দরে সুভাষের দাদা শরতচন্দ্র বসুর কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। বাংলায় চিঠিটি, শরৎ বোসকে উদ্দেশ্য করে লিখিত ছিল। তাতে এমিলি বা অনিতার কোনও উল্লেখ ছিল না। রোমার বোন গীতা পরে দাবি করেন চিঠিটি ডাকযোগে এলগিন রোডের বাড়িতে আসে। আরেকটি সংস্করণে, শিসির বোস লিখেছেন যে চিঠিটি একটি সিগারের বাক্সে পাওয়া গিয়েছিল।

এও বলা হয় একটি চিঠি শিসির বসু তুতো ভাই অরবিন্দকে ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি বার্লিন থেকে লিখেছিলেন। যাতে শিশির সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বিয়ে নিয়ে। তাই তিনি বার্লিন এবং ভিয়েনায় বন্ধুদের “কাকিমার বিবাহের শংসাপত্র এবং অনিতার জন্মের শংসাপত্র” দেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন।

নেতাজি গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে এমিলি এবং অনিতা নেতাজিকে আত্মগোপনে বাধ্য করার ষড়যন্ত্রের দুটি চরিত্র মাত্র। আর তাই বারবার এই ক্ষেত্রে উঠে আসে নেহেরু ও কংগ্রেসের নাম। যার ভিত্তিতে কংগ্রেস কমিটির অনিতাকে বছরে ৬ হাজার টাকার প্রসঙ্গও এসেছে বারবার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here