ভারতীয় দুই মহাকাব্যের একটি মহাভারত। মহাভারত সত্যিই ‘মহা’ ‘ভারত’। এর কোন ও শেশ নেই। যা আমরা জানি তার বাইরেও বহু তথ্য রয়েছে। আজ জেনে নেওয়া যাক দুই পর্বে তারই কিছু। আজ প্রথম পর্ব।
সুদূর অতীতে মহাভারতকে মোটেই মহাভারত বলা হত না। তাঁর নাম ছিল জয়ম বা জয়া। সময় অনুসারে আদি মহাকাব্যের নাম ছিল জয়া, তারপর একে বিজয়া, তারপর ভারত এবং শেষে মহাভারত বলা হয়।
জয়ায় প্রায় পঁচিশ হাজার শ্লোক ছিল, যেখানে চূড়ান্ত রূপে শ্লোক ছিল এক লক্ষেরও বেশি শ্লোক। জয়া আধ্যাত্মিক বিজয় সম্পর্কে, বিজয়া বস্তুগত বিজয় সম্পর্কে, ভারত ছিল একটি বংশের গল্প এবং মহাভারত ভারতবর্ষ নামক দেশের জ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত করে।
সহদেব ছিলে পান্ডবদের মধ্যে কনিষ্ঠ। তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন, ফলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা সবই জানতেন। তিনি যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কেও জানতেন। জেনেও নীরব থাকার কারণ সহদেবের প্রতি অভিশাপ ছিল যে তিনি যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার আগে ফলাফল সম্পর্কে বললে তাঁর মৃত্যু হবে। মহাভারতের এমন কিছু সংস্করণ রয়েছে যা দাবি করে যে সহদেব এই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হওয়ার জন্য তিনি তাঁর পিতার মস্তিষ্ক ভক্ষণ করেছিলেন। অন্যদিকে, সহদেবকে একজন জ্যোতিষী এবং অসম্ভব প্রতিভাধারী হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।
এই যে দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুঃশলা-কৌরবদের এমন নামে ডাকা হয় আসলে কিন্তু তাদের নাম দুঃ দিয়ে শুরুই হয়নি। প্রত্যেকেরই নাম শুরু হয়েছি ‘সু’ দিয়ে। কৌরবদের মন্দ স্বভাবের জন্য সু হয়ে যায় ‘দুঃ’। এইভাবেই সুযোধন হয় দুর্যোধন, সুঃশাসন হয় দুঃশাসন।
আরেকটি তত্ত্ব হল দুর্যোধনের জন্মের সময় তার পিতা ধৃতরাষ্ট্র তার নাম রাখেন সুযোধন। গদাযুদ্ধে আগ্রহী সুয়োধন কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের কাছে গদা চালনার শিক্ষা নেন। চূড়ান্ত অনুশীলনের পর গদাযুদ্ধে সুযোধন বলরামকে পরাজিত করেন। শিষ্যর পারদর্শীতায় বলরাম খুব খুশি হয়ে তাঁকে ‘দুর্যোধন’ উপাধি দেন যার অর্থ হয় ‘এমন এক যোদ্ধা যাকে পরাজিত করা যায় না’।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাসের আগে ২৭ জন বেদব্যাস ছিলেন। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ ছিলেন ২৮ তম বেদব্যাস, যোজনগন্ধ্যা সত্যবতী ও পরাশর মুনীর পুত্রের এরূপ নামকরণের কারণ তঁার গাত্র বর্ণ পাকা গমের মতো। এমন গায়ের রঙ আর একজনেরই ছিল, তিনি কৃষ্ণ। বেদব্যাস একটি দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তাঁর নাম হয় কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ।
ধৃতরাষ্ট্রের দুই পুত্র, বিকর্ণ এবং যুযুৎসু দুর্যোধনের কর্মকাণ্ডে মত দেননি। পাশা খজেলায় দ্রৌপদীকে বাজি রেখে যুধিষ্ঠির যখন পরাজিত হন তখন দুর্যোপধন দুঃসাসনকে আদেশ করেছিলেন পাঞ্চালীর বস্ত্রহরণের। তাতে বাধা দিয়েছিলেন বিকর্ণ। তিনি ছিলেন গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় পুত্র। দাদার বিরুদ্ধে গিয়েও বিকর্ণ নিজের ধর্ম বজায় রেখেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। দেবব্রত ভীষ্ম তাঁকে কৌরব পক্ষের একজন মহান যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। গান্ধারীর দাসী বৈশ্যা ও রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র ছিলেন যুযুৎসু। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি পান্ডব পক্ষে যোগদান করেন। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শেশে যুযুৎসুই একমাত্র কৌরব যিনি জীবিত ছিলেন।
মহাভারত অনুসারে, বিদুর ছিলেন হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডুর সৎ ভাই। তিনি ঋষি ব্যাস এবং দাসী সুদ্রির পুত্র। বিদুর ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্রের একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন। ঋষি মাণ্ডব্যের অভিশাপের কারণে তাঁকে মানুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়েছিল।
অভিমন্যু আসলে কল্যবণ নামে এক দৈত্যের (দানব) আত্মা ছিলেন। কল্যবণকে পুড়িয়ে মারার পর কৃষ্ণ তার আত্মাকে বন্দি করে দ্বারকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। অভিমন্যুর একমাত্র দুর্বলতা হল চক্রব্যূহ সম্পর্কে তার আংশিক জ্ঞান। তাই অভিমন্যুকে হত্যা করার জন্য চক্রব্যুহ রচনা করা হয়েছিল। কারণ এটিই একমাত্র উপায় ছিল যার মাধ্যমে অভিমন্যু মোক্ষ লাভ করতে পারার। তাই কৃষ্ণ কোনওদিনও নিজের ভাগ্নেকে চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় শেখাননি।
দেবব্রত যখন যুবক ছিলেন, তখন তার বাবা শান্তনু শিকারে গিয়েছিলেন মৎস্যগন্ধা সত্যবতীর প্রেমে পড়েন। শান্তনু সত্যবতীকে বিয়ে করতে চাইলে কন্যার পিতা হস্তিনাপুরের সম্রাটকে এক কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন। তিনি বলেন সত্যবতীকে রাজা তখনই শুধুমাত্র বিয়ে পারবেন যদি সত্যবতীর ছেলেরা তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়। এদিকে শান্তনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবব্রত সিংহাসনে বসার উপযুক্ত। তাই শান্তনু ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে গেলেন রাজ্যে। দেবব্রত পিতাকে মর্মাহত দেখে সত্যবতীর কাছে যান এবং প্রতিজ্ঞা করেন হস্তিনাপুরের সিঙ্গহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনি সরে যাবেন। তাতেও সত্যবতী সন্তুষ্ট না হলে দেবব্রত নিজের কাছে নিজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন যে তিনি সারা জীবন ব্রহ্মচারীর জীবনযাপন করবেন। কোনওদিন বিবাহ বা নারঈসঙ্গ করবেন না। তারপরই তিনি ভীষ্ম নামে পরিচিত হন।
কর্ণ একবার শব্দভেদী বাণ অনুশীলন করার সময়, একটি গরুকে বন্য প্রাণী ভেবে তিরবিদ্ধ করে ফেলেছিলেন। গৃহ গরু সম্পদ। এক ব্রাহ্মণের মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট করেছেন বলে তিনি বিচলিত হয়ে কর্ণকে অভিশাপ দেন যে যুদ্ধে মনোযোগবিমুখ হলে শত্রুর হাতে তাঁর মৃত্যু হবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে যখন কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে যায় তখন কর্ণ সেটি মাটি থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। সেই সময় অর্জুন মহারথীর দিকে তির নিক্ষেপ করেন।
আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে এই ভারত এক মহাযুদ্ধই দেখেছিল। মহাভারতের আসল লড়াই শুধু পাণ্ডব এবং কৌরবদের মধ্যে ছিল না, এতে রোম, গ্রিসের বাহিনীও অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসাত্মক আকার নেয়, প্রাচীন সামাজিক কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দেয়। এমনকি মানবজগতের টিকে থাকা নিয়েও প্রশ্ন চিহ্নের উত্থাপন করে।
অভিমন্যু ছিলেন বলরামের জামাতা। অভিমন্যুর স্ত্রী বৎসলা ছিলেন বলরামের কন্যা। বলরাম চেয়েছিলেন যে বৎসলা দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণকে বিয়ে করুক। অভিমন্যু এবং বৎস্যলা একে অপরকে ভালবাসতেন এবং তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। অভিমন্যু তাই দাদা ঘটোৎকচের সাহায্য নেন। ঘটোৎকচ মায়াবলে বিবাহস্থলে উপস্থিত হয়ে বরকে ভয় দেখান। তারপর বৎস্যলাকে সঙ্গে নিয়ে উড়ে যান অভিমন্যুর কাছে। লক্ষ্মণ এই সব দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হন এবং প্রতিজ্ঞা করেন আজীবন বিয়ে না করার।
যুদ্ধের সময় কৌরবের পক্ষে থাকা ভীষ্মকে দুর্যোধন বারবার বছিলেন পাণ্ডবর প্রতি স্নেহ বৎসল হয়ে তিনি পিতামহ পঞ্চপাণ্ডবকে হ্যা কছেন না। এমন অভিযোগ শুনে ভীষ্ম খুব রেগে গেলেন এবং ক্রোধমন্ত্রে ভরা পাঁচটি সোনার তির নিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে পরেরদিন সূর্যাস্তের আগে পাণ্ডবদের বধ কর। এদিকে দুর্যোধনের সন্দেহ ছিল যে ভীষ্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে কোনও অন্যায় করবেন না। তাই পরদিন সকালে তিরগুলি নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তৎক্ষণাৎ ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে দুর্যোধন তাঁকে বর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অর্জুন সেই বর হিসাবে পাঁচটি স্বর্ণবাণ এখন চাইবেন। মাধবের কথা মতোই কাজ হল। প্রতিশ্রুতি রাখতে দুর্যোধন তিরগুলি দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন।
যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের ১৫ বছর পর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী সন্ন্যাস নিয়ে বনে চলে যান। এর প্রধান কারণ ছিল ভীমের কটূক্তি, যা তাদের ক্রমশ হতাশ করে তুলছিল।
দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করা দুর্যোধন নয়, কর্ণের প্ররোচনায় হয়েছিল। দ্রৌপদীকে সভাকক্ষে আসতে বলা ছাড়া গোটা পর্বে দুর্যোধন আশ্চর্যভাবে নীরব ছিলেন।