তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আর কোনও ব্রেন ড্রেন হয়ে অন্য রাজ্যে চলে যাবেন না। স্বপ্ন দেখেছিলেন রাজ্যে শিল্পায়নের। না চপশিল্প নয়, প্রকৃত অর্থে শিল্পায়ন বলতে যা বোঝায় তাই। তাঁর মস্তিষ্কে ছিল রাজ্যে টাটার শিল্পায়ন, ইনফোসিসের চিন্তাভাবনা। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। স্বপ্নভঙ্গের দায় তুলে নিয়েছিলেন নিজ কাঁধে। তিনি— বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কোলাপুরি চপ্পলে আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক। বৃহস্পতিবার প্রয়াত হয়েছেন তিনি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্ম উত্তর কলকাতায় ১ মার্চ, ১৯৪৪। একেবারে কাঠ বাঙাল, পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশে। শ্যামপুকুর এলাকায় শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় থেকে পাশ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। তাঁর কাকা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। খেলা ধুলায় তুখোড় ছিলেন। কবাডি, ক্রিকেট খেলা ছিল তাঁর নেশা। কিন্তু চোখের সমস্যার জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল ক্রিকেট।
১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের পর ১৯৬৪ সালে সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি) ভেঙে সিপিএম বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তৈরি হয়। এর দু’বছর পর ১৯৬৬ সালে বুদ্ধদেব সিপিএমের সদস্য হন। সিপিএমের যুব সংগঠনটির তখন সূচনা লগ্ন। ষাটের দশকের শেষের দিকে প্রাদেশিক গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফ)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক হন বুদ্ধদেব। খাদ্য আন্দোলনে অংশ নেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
বুদ্ধদেব সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য হন সত্তরের দশকের গোড়ায়। ১৯৭৭ সালে কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথম নির্বাচনে জেতেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রিসভায় তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের দায়িত্ব পালন করেন। এটি পরে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর নামে পরিচিত হয়। ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হন বুদ্ধদেব। পরে ১৯৮৭ সালে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে জিতে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হন। সেই থেকেই তাঁর কেন্দ্র যাদবপুর। অথচ যাদবপুর থেকেই তিনি শেষবারের মতো পরাজয়ের মুখ দেখেছিলে ২০১১ সালে।
তথ্য সংস্কৃতির পাশাপাশি বুদ্ধদেব স্বরাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরেরও দায়িত্ব সামলেছেন জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায়। প্রশাসনের তরফে তিনিই পুলিশ দফতর পরিচালনা করতেন। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেন জ্যোতিবাবু অবসর নেওয়ার পর। ২০১১ পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন।
রাজ্যে সত্যি সত্যিই শিল্পায়নের জোয়ার আনতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর এক লক্ষ টাকার গাড়ি কারখানার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যে সিঙ্গুরে জমি পরিদর্শনে গিয়ে গ্রামবাসীদের বিরোধিতার মুখে পড়েন টাটার প্রতিনিধিরা। এ নিয়ে বিধানসভায় তৃণমূল সরব হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা হয়নি। মমতা-সহ বিরোধীদের বিরোধিতার মুখে পড়ে রতন টাটা সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা করেন।
সেই সময় বাম সরকারের স্লোগান ছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’।
২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে গুলি চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহত হন ১৪ জন গ্রামবাসী। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে নিজের ঘাড়ে এর দায় নিয়েছিলেন তিনি। পরে ২০১৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোর জন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন বুদ্ধদেব।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে একতরফা ফলের দু’বছরের মধ্যে, ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে খানিকটা ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। ধাক্কা বৃহৎ আকার ধারণ করে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে। ৪২টি আসনের মধ্যে ২৭টিতে হেরে যায় বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। ১৯টি আসনে জেতে বিরোধী তৃণমূল। তাদের সমর্থনে আরও একটি আসনে জেতে এসইউসি। তখন থেকেই রাজ্যের পরিস্থিতির উপর রাশ হারাতে শুরু করে বুদ্ধদেবের প্রশাসন। নিচুতলার কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় দলবদলের হিড়িক।
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে হারিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। অবসান হয় দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের। রাজভবনে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন বুদ্ধদেব। সেই আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছিলেন তিনি।
২০১১-র নির্বাচনে হারের পর থেকেই বুদ্ধদেবের শরীর ভাঙতে শুরু করে। দলীয় কাজকর্ম থেকেও ক্রমশ অব্যাহতি নিয়ে নেন তিনি। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও দু’বেলা আলিমুদ্দিনের দলীয় দফতরে আসতেন মূলত পড়াশোনা করার জন্য। ধীরে ধীরে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। শ্বাসকষ্টের পুরনো সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। বাড়িতেও চলে পর্যবেক্ষণ। সিওপিডি-র সমস্যার জন্য ২০১০ সাল থেকে বিমানে উঠতে পারতেন না। শেষ বার তাঁকে জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালে বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে। কিন্তু ধুলোবালির প্রকোপে গাড়ি থেকেও নামতে পারেননি।
পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট দু’কামরার সরকারি ফ্ল্যাটই ছিল ধ্যান জ্ঞান। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেও সেইখানেই থেকেছেন তিনি। সাহিত্যপ্রেমী বুদ্ধদেব বহু নাটক, প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশি কবি-লেখকদের লেখা অনুবাদও করেছেন। তাঁর লেখা বই ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’য় সমালোচনা করেছিলেন বর্তমান চিনের নীতিরও। ২০২২ সালে বুদ্ধবাবুকে পদ্মভূষণ সম্মানের জন্য মনোনীত করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনৈতিক সাফল্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জীবনে যেমনটাই থাকুক না কেন, আপামর মানুশের কাছে তিনি এক নিপাট ভদ্রলোক হয়েই রয়ে যাবেন চিরকাল।