
প্রীতম অধিকারী, কলকাতা, ১৩ ডিসেম্বর: ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। মেসি ট্যুর ঘিরে উন্মাদনায় ফুটছিল গোটা শহর। মনোরম একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গোটা রাজ্য জুড়ে কিন্তু শেষ ভাল হল না। হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কিনেও মেসি দর্শন হল না। বরং মেসি ট্যুরের নামে মন্ত্রী-আমলা-ক্লাব কর্তাদের জটলা দেখল দর্শকরা।
সুয়ারেজ-ডি পল’রা থাকলেও এই সফরের মুখ ছিলেন মেসি। কিন্তু রাজ্যের মন্ত্রী, আমলা এবং কর্তাদের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে বিশ্বফুটবলের বরপুত্র’কে দেখতেই পেলেন না হাজার হাজার সমর্থক। এ দিন মেসি সকাল সাড়ে ১১’টায় ঢোকেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। এর কিছু মিনিট পরই তিনি পা রাখেন যুবভারতী’র সবুজ গালিচায়। মেসি মাঠে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ঘিরে ধরেন প্রায় ৭০-৮০ জন। এর মধ্যে নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াও ছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, আমলা এবং বিভিন্ন ক্লাব কর্তারা। এ দিন অধিকাংশ সময় মেসিকে নিয়ে ছবি এবং ভিডিও তুলে গিয়েছেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী।
১১:৫২ -এ মাঠ থেকে বেরিয়ে যান মেসি। মাত্র ২২ মিনিটের জন্য স্টেডিয়ামে থাকেন মেসি। কিন্তু মন্ত্রীরা এমন ভাবে ঘিরে ছিলেন তাঁকে, ভক্তরা কোনও ভাবেই দেখতে পাচ্ছিলেন না। ফলস্বরূপ স্বপ্নের নায়ক’কে দেখতে না পেয়ে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হতে থাকেন সমর্থকরা। পরিস্থিতি অবস্থা বুঝে স্টেডিয়াম থেকে মেসি বের করে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী। তার পরেই শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব লীলা। রূপ নেয় রণক্ষেত্রের যুবভারতি। মেসিকে দেখতে না পেয়ে স্টেডিয়ামে ভাঙচুর শুরু করেন উন্মত্ত দর্শক’রা।
মোটা টাকায় টিকিট কিনে মাঠে এসেও মেসিকে দেখতে না পাওয়ায় ফুটবলপ্রেমীরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হয়ে ওঠেন মারমুখী। শুরু হয় গ্যালারিতে লাগানো হোর্ডিং ভাঙচুর। গ্যালারির চেয়ার ভেঙে মাঠে ছুড়তে শুরু করেন ক্ষুব্ধ ফুটবলপ্রেমীরা। ক্রীড়ামন্ত্রী এবং পুলিশ কর্তাদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় বোতল। এখানেই শেষ নয়, স্টেডিয়ামের চারিদিকে সাউন্ড সিস্টেমও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। স্টেডিয়ামের টানেলের পাশেই মেসির বসার জন্য একটি ছাউনি করা হয়েছিল। সেটি প্রথমে ভেঙে ফেলা হয় এবং তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এর কিছুক্ষণ পরেই ফেন্সিংয়ের গেট ভেঙে হু-হু করে মাঠে ঢুকতে শুরু করেন সমর্থকরা। এমন সময় পুলিশ ছিল নীরব দর্শক। কিছুটা পর সম্বিত ফিরলে লাঠি উঁচিয়ে ক্ষুব্ধ জনতাকে তাড়া করে গ্যালারিতে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবার যুবভারতীর দখল নেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এক কথায় সল্ট লেক স্টেডিয়াম চেহারা নেয় রণক্ষেত্রের।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয় র্যাফ। যদিও এত পরিমাণ সমর্থকদের সামনে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশ বাহিনী। ফুটবলপ্রেমীদের ক্ষোভ মূলত নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। তাঁরা ফুটবলের রাজপুত্রকে ঘিরে থাকার জন্যই গ্যালারি থেকে তাঁকে দেখা যায়নি। চড়া দামে টিকিট কিনেও মেসিকে তাঁদের দেখা হল না। এদিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শাহরুখ খানের মাঠে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও মেসি থাকাকালীন তাঁরা কেউ মাঠে আসেননি। এরপর মেসি বেরিয়ে যাওয়ার পর সৌরভ মাঠে প্রবেশ করলেও পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তিনি ফের ভিতরে চলে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা’র দুপুর ১২’টায় স্টেডিয়ামে আসার কথা ছিল কিন্তু ঘটনার খবর পেয়ে মাঝরাস্তা থেকেই তিনি ফিরে যান। অন্যদিকে হোটেলে শাহরুখের সঙ্গে দেখা করেন মেসি। সেখানে বাদশার সঙ্গে ছবিও তোলেন তিনি।
এ দিন যতটা সময় মেসি মাঠে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়া মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস যেভাবে মেসির গায়ে গায়ে লেগেছিলেন তাতে দেখে মনে হচ্ছিল মেসিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। এরই মাঝে মেসি, রড্রিগো ডি পল এবং লুইস সুয়ারেজ’কে নিয়ে টলিউডের প্রতিনিধি হিসেবে ছবি তোলেন শুভশ্রী।
লিওনেল মেসি’র মতো একজন মহাতারকা কলকাতায় আসার আগে যে রকম মনোরম পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তিনি চলে যাওয়ার পর বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। তবে, এর জন্য কোনও ভাবেই দর্শকদের দোষারোপ করা যাবে না। দর্শকদের ক্রোধ ‘অনৈতিক’ নয়। যুবভারতীতে মেসির সফর ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে সবচেয়ে সস্তার টিকিটের দামই ছিল ৪ হাজার টাকার উপর। বিশ্বজয়ী ফুটবলারকে সামনে থেকে এক বার চোখের দেখা দেখবেন বলে তাঁর অনুগামীরা টিকিটের দামে বাছবিচার করেননি। কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৫ হাজার, কেউ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটেছিলেন। সেখানে মুষ্টিমেয় সুবিধা এবং ক্ষমতা ভোগীদের কারণে সাধারণ মানুষকে যদি প্রতারিত হতে হয় তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং মহলের উপর বর্তায়, সাধারণ মানুষের উপর নয়।
মেসি ট্যুরের অন্যতম কারিগর শতদ্রু দত্ত’কে এ দিন বিমানবন্দরে থেকেই প্রথমে আটক এবং পরে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই সঙ্গে সমর্থকদের টিকিট মূল্য ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু ক্ষতের দাগ এত সহজে মুছে ফেলা যায় না! মেসি’কে না দেখতে পাওয়া সমর্থকদের তাণ্ডব ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে ভারতীয় ফুটবলের অবস্থা বলার মতো নয়, এই পরিস্থিতিতে মেসি’কে ঘিরে যা কিছু ঘটে গেল তা মোটেই কাম্য নয়। যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেয়নি রাজ্য সরকার বরং সাংবাদিকদের দেখে ছুটে গাড়িতে উঠে গিয়েছেন ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। সেই সঙ্গে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার প্ৰচেষ্টাও শুরু হয়ে গিয়েছে। শাসক দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে বিরোধী দল।



