পান্নালাল ভট্টাচার্য। মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও তিনি ও ‘শ্যামাসঙ্গীত’ যেন একে অপরের সমার্থক। এই তো সামনেই কালীপুজো। আর কালীপুজো যেন পান্নালালের গান ছাড়া ভাবা যায় না। ধর্মে শাক্ত কিন্তু মন্ত্রে বৈষ্ণব বারেন্দ্র ভাদুড়ি বংশের সন্তান যোগাচার্য নগেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি ছিলেন মস্ত যোগীপুরুষ। যৌবনেই তিনি সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। যোগী নগেন্দ্রনাথের তিরোধান হয় ১৯২৬ সালে। এই নগেন্দ্রনাথের ভাইপো হলেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পৌরহিত্য করার জন্য তাঁরা ভট্টাচার্য উপাধি লাভ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের আদি বাড়ি ছিল হাওড়া জেলার পায়রাটুঙি গ্রামে। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে সাংসারিক মনোমালিন্যের কারণে তিনি ভিটে ছেড়ে চলে যান সাঁতরাগাছিতে, আপন কুলগুরুর আবাসে। এই আবাসেই সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবাহ হয় অন্নপূর্ণা দেবীর। এঁদের ছয় ছেলে, সাত মেয়ে।
বহু মৃত্যু দেখতে হয়েছিল অন্নুপূর্ণা দেবীকে তাঁর জীবদ্দশায়। বড়ো ছেলে ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত এবং তারপর তাঁর বড়ো মেয়ে ইন্দুমতী। তারপর তাঁর আরেক ছেলে, যিনি মারা যান অন্নপ্রাশনের ঠিক আগের দিন। এরপর তাঁর দুই মেয়ে। তারাও গত হন অল্পবয়সেই। এরপর জন্ম নেন আরেক পুত্র ননীগোপাল। দুর্গাপুজোর সময় একজনের কাঁধে চেপে ঘুরতে ঘুরতে পড়ে গিয়ে মারা যান তিনিও। এরপর জন্ম নেন প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য, বাংলা সঙ্গীতজগতের পরিচিত নাম। তারপর এক মেয়ে শান্তিময়ী। তাঁর পরের জন হলেন বাংলা সঙ্গীতজগতের একটি যুগ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য। তারপর আরও দুই মেয়ে সরস্বতী ও টোকে। টোকে টাইফয়েডে মারা যান চার বছর বয়সে।
এরপর অন্নপূর্ণা দেবীর এক সন্তান যখন আট মাসের গর্ভে, তখন প্রয়াত হন স্বামী সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। এরপরে সাঁতরাগাছিতে উঠে আসেন তিনি এবং এখানেই মারা যান তাঁর বড়ো ছেলে লক্ষ্মীকান্ত। তারপর তিনি ওঠেন রামরাজাতলায় নারায়ণ তেলির বাড়িতে। এখানেই ৫ মার্চ, বুধবার জন্ম হয় কিংবদন্তি শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্যর। স্বামীর মৃত্যুর জন্য অন্নপূর্ণা বরাবর দায়ী করে এসেছিলেন পান্নালালকে। তাই তাঁর বাবা-মা দুইই যেন ছিলেন দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য।
গানের পাশাপাশি পান্নালালের নেশা ছিল রান্নাকরা, মাছধরা, ঘুড়ি ওড়ানো আর ফুটবল খেলা।ফুটবল বলতে অজ্ঞান পান্নালাল ভীষণ ভক্ত ছিলেন মোহনবাগানের। পান্নালালের বয়স যখন ১৮ বা ১৯, সেই সময় একদিন ফুটবল খেলতে কগিয়ে চোখে ভয়ঙ্কর আঘাত লাগে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ৪৫০ টাকা মূল্যের ২৫টি ইঞ্জেকশন দিয়ে তাঁর চোখ ঠিক করা হয়। তবে মণি কিছুটা সরে যায়। কিন্তু এই ঘটনার পর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও বৌদিকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেন পান্নালাল।
শ্যামাসঙ্গীতের সমার্থক পান্নালালের প্রথম রেকর্ড কিন্তু আধুনিক গানের। এক পিঠে ছিল রামকৃষ্ণ চন্দের কথায় ‘শিল্পের বেলা খেলার ছলে’ এবং অমিত ভট্টাচার্য্যের কথায় ‘সেদিনের সেই গানখানি’; সুর দিয়েছিলেন ধীরেন ভট্টাচার্য্য। দাদাকে নিজের আদর্শ মনে করতেন পান্নালাল। তিনি মনে করতেন ধনঞ্জয় ভর্টাচার্যের মতো ভাল শ্যামাসঙ্গীত আর কেউ গাইতে প্রেন না। তিনিও না। অদিকে দাদার ভাবনা ছিল কিন্তু পুরো উলটো। তিনি প্রকাশ্যে বলতেন, পান্নালাল যেভাবে ভক্তিগীতি গাওয়ার সময় ‘মা’ বলেন ওভাবে আর কারও পক্ষে মা’কে ডাকা সম্ভব নয়।
পান্নালাল ভট্টাচার্য বারবার ভবতারিণী কালীকে দেখতে চাইতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দাদা ধনঞ্জয় মা কালীর দর্শন পেয়েছেন। শোনা যায় একবার ট্রেনে করে আসছেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্রের মতো প্রথিতযশা শিল্পীরা। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন পান্নালালও। ট্রেন বালি স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই তিনি ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলেন। জানালেন মাকে তুঁতে বেনারসি পরানো হয়েছে, তিনি দেখবেন। সকলে নামলেন ট্রেন থেকে। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে দেখলেন সেদিন সত্যি মাকে তুঁতে রঙের বেনারসিই পরানো হয়েছে।
এই মানুষ যদি মায়ের দর্শন না পান তিনি তো পাগল হবেনই! মায়ের কাছে তাঁর প্রশ্ন ছিল দাদা ধনঞ্জয় যদি ভক্তিগীতি গেয়ে ভবতারিণী মায়ের দর্শন পেতে পারেন, তাহলে তিনি কেন পাবেন না! একসময় যে পান্নালাল ঘোর সংসারী, স্ত্রী-কন্যা সান্নিধ্যে থাকতে ভালবাসতেন তিনিই ধীরে ধিরে ছিঁড়তে লাগলেন সংসারের বাঁধন। যেতে লাগলেন শ্মশানে। সেখানে গিয়ে কাঁদতেন শিশুর মতো। শেষে বোধহয় মায়ের উপর ঘোর অভিমানেই স্থির করলেন কালী যদি তাঁর কাছে না আসেন তিনিই তাঁর কাছে যাবেন।
২৬ মার্চ, ১৯৬৬ সাল। রবিবার। কাঁকুলিয়া রোডের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিলেন পান্নালাল। কারণ কী, জানা যায় না স্পষ্ট। সকালে তাঁর ভাইপো অর্থাৎ ধনঞ্জয়বাবুর বড়ো ছেলে শ্যামলাল গঙ্গাস্নান করে এসে দেখলেন তাঁর ছোটোমাসি গোমড়া মুখে বসে। চাপাচাপির পর বললেন, পানু আর নেই! ঘুমোচ্ছিলেন ধনঞ্জয়। তাঁকে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হল দুঃসংবাদ। কাঁপতে লাগলেন ধনঞ্জয়।
আকাশবাণীতে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে সেই দুঃসংবাদ। পুত্রসম ‘পানু’র দেহ নিয়ে আসা হল ধনঞ্জয়ের স্ত্রী-কে দেখাতে। তিনি তখন খুব অসুস্থ। অনেকে মিলে তাঁকে গাড়ির কাছে ধরে আনতে আছাড়ে পড়লেন। সে কি বিলাপ!
গান গেয়েছেন তো বটেই, লিখেওছেন পান্নালাল! শ্রীঅভয় ছদ্মনামে লিখেছিলেন ‘তোর মত মা এত আপন কি আর শ্যামা আমার আছে/তুই যদি মা মুখ ফিরাবি যাব তবে কাহার কাছে? …’ সুর করে গেয়েছিলেন নিজেই। শুনলে মনে হয় যেন ছোট্ট শিশুটির আবদার তাঁর মায়ের কাছে! তাঁর গানেই অমর হয়ে গেলেন পান্নালাল। অর্ধশতাব্দীকাল পরেও শ্যামাসঙ্গীতে তাঁর নামটাই সবার আগে মনে আসে শ্রোতাদের। এইখানেই তিনি চিরন্তন।