বারোয়ারি পুজোর বিশেষত্ব যেমন তার থিমের অভিনবত্বে তেমনই বনেদি বাড়ির পুজো শ্রেষ্ঠ তার ঐতিহ্যে। বহু জমিদার বাড়ির পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শত শত বছরের অজানা রোমহর্ষক ইতিহাস। সেরকমই কিছু বিস্ময়কর ঘটনার সাক্ষী নবদ্বীপের ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো।
নদিয়ার নবদ্বীপের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে জগন্নাথতলা এলাকার ভট্টাচার্য বাড়ির দূর্গা পুজো অন্যতম। রক্তবর্ণেই পুজিত হন ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে। তাই ‘লাল দূর্গা’ নামেও খ্যাত এই প্রতিমা। দশভূজার গাত্রবর্ণ লাল কেন? এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে এক অলৌকিক মর্মান্তিক কাহিনি। সেই গল্পই জানালেন ভট্টাচার্য বাড়ির প্রবীণ সদস্য কুমারনাথ ভট্টাচার্য।
পূর্ববঙ্গের ঢাকায় প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে শুরু হলেও গত একশো বছর ধরে নবদ্বীপের পূণ্যভূমিতেই পূজিত হয়ে চলেছেন ভট্টাচার্য বাড়ির লাল দূর্গা।
ঘটনাটি হল সতেরো শতকের। তৎকালীন গৃহকর্তা ছিলেন রাঘবরাম ভট্টাচার্য। নবমীর দিন মায়ের পুজো চলছিল। তিথি পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে রাঘবরাম খুব দ্রুত চণ্ডীপাঠ করছিলেন। পিতার পাঠ শ্রুতিমধুর লাগছিল না পুত্রের। তাই তিনি তাঁর বাবাকে এসে সে’কথা জানান। তৎক্ষণাৎ নিজের আসন ছেড়ে দেন রাঘবরাম, পুত্রকেই বলেন চণ্ডীপাঠ করতে। বাবার আদেশানুসারে পুর্বদিকে মুখ করে পাঠে বসেন পুত্র। তখনই ঘটে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। হঠাৎই দিক পরিবর্তন করেন দেবী মূর্তি। দক্ষিণদিক থেকে মায়ের মুখ পরিবর্তিত হয়ে চলে আসে পশ্চিমদিকে। রাঘবরামের পুত্রের একেবারে মুখোমুখি। ক্রমেই রক্তবর্ণ ধারণ করেন দেবী। অন্যদিকে রাঘবরামের পুত্র হয়ে যেতে থাকেন রক্তশূন্য, একেবারে ফ্যাকাসে। সেইদিনই প্রাণবিয়োগ ঘটে তাঁর। এই ঘটনার পরেই তাঁর পিতা রাঘবরাম আদেশ দেন আর কোনওদিন যেন দেবীর পুজোয় চণ্ডীপাঠ না করা হয় । রক্তবর্ণেই পূজ্য হবেন ভট্টাচার্য বাড়ির দূর্গা মা।
সেইদিন থেকে আজ পর্যন্ত লৌহ বর্ণে, পশ্চিমমুখে চণ্ডীপাঠ ছাড়াই পূজিত হয়ে চলেছেন এ বাড়ির মেয়ে। নৈবেদ্য হিসাবে দেবীকে পরিবেশন করা হয় বোয়াল মাছ ও থোড় দিয়ে প্রস্তুত করা বিশেষ ভোগ। আগে বলির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে কুমড়ো বলি দেওয়া হয়।
শতোর্ধ্ব বছর ধরে সমস্ত রীতি রেওয়াজ মেনেই প্রতি বছর ঘরে ফেরেন ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে। রোমাঞ্চকর ও মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি বিজড়িত ভট্টাচার্য বাড়ির শারদোৎসব নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী পুজোর দাবীদার।